ওদিকে কান্না ফোঁপানি হাউমাউ বকাবকি বিবিধ আওয়াজের মধ্যে তথাগত এগিয়ে এসে ওসির হাত ধরে ফেলেন। কৃতজ্ঞতায় তাঁর গলা থেকে আওয়াজ বেরোচ্ছিল না। শুধু ধরা গলায় বললেন, কী বলে ধন্যবাদ দেব ভাই? এ উপকার জীবনে ভুলব না। আপনার বসের নামটা যদি বলেন। আর বলছি কী, এত রাতে এলেন, অন্তত রাতের খাবারটা খেয়ে যাবেন না?
আরে আমাদের কি সেই কপাল আছে স্যার?ফের জিপে বসতে বসতে দুঃখপ্রকাশ করেন ওসি, আমরা হলাম গিয়ে স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চ, সর্বঘটে কাঠালি কলা। এই তো ট্রেন থেকে নেমেছি কী নামিনি, খবর পেলাম রাজারহাটে কোন এক আন্ডার কত্সট্রাকশন বিল্ডিঙে নাকি দুপিস বডি পাওয়া গেছে। বলে তর্জনীটা তুলে গলার এদিক থেকে ওদিক নিয়ে যান, বডি আছে, মুণ্ডু হাপিস। সে নাকি এমন কেটেছে সারা বিল্ডিঙের একতলা রক্তে থইথই। বড় সাহেব অত রাতেই ফোন করে বললেন কেসটা যেন আমি আর ওয়াসিম হ্যাঁন্ডেল করি… কী আর বলি, নাওয়া-খাওয়া নেই, দাদা। এত্ত এত্ত ক্রাইম, আর এই কটা মাত্র পুলিশ… এই নিন, কার্ডটা ধরুন, এতে আমার উপরওয়ালার নাম আর মোবাইল নাম্বার, কথা বলে নেবেন। চলি তা হলে? কী রে ওয়াসিম, চল বাপ, স্টিয়ারিং ধর। আজ তোরও উপোস, আমারও… বলতে বলতে জিপটা স্টার্ট করে বেরিয়ে যায় পাড়ার মোড়ের দিকে।
*********
রাত বারোটা নাগাদ ট্যাক্সিটা নিঃশব্দ ঘাতকের মতোই এসে দাঁড়াল রাজারহাটের অভিশপ্ত ফ্ল্যাটটার সামনে। ফটাফট গেট খুলে নেমে এল টেনিয়া, আসলাম আর বনোয়ারি। শিবা জড়ানো গলায় বলল, গাইটা গ্যাএজ কয়ে আসচি গুউ, স্লা আগেই সুউ কএ দিও না।
ওরা তিনজনেই টলছিল। চাঁদের আলো আর শীর্ণ ল্যাম্পপোস্টের মরা আলো মিশিয়ে ভূতুড়ে দেখাচ্ছিল ওদের। যেন নরকের আগুনের আলো-ছায়ায় দুলছে তিনটি মূর্তিমান পাপ।
আজকে নেশা করেছে ওরা, প্রচুর নেশা। প্রথমে ভিআইপির পাশে এক ড্যান্স বারে, তারপর আসলামের কৈখালির আড্ডায়। আহা, নম্বরি মাল এনেছিল আজ আসলাম, মালানা ক্রিম!
গেটে সামন্ত বসেছিল, টেনিয়া জিজ্ঞেস করে, কি রে হারামি, মালগুলো খেতে দিয়েছিলিস?
গেছিলাম দিতে, দরজা খোলেনি।
মানে, কুত্তিগুলো দরজা বন্ধ করে ভাবছে পার পাবে? আব্বে এ শিবা, জe আ বে। চ্যল, ওপরে চ্যল।
আগে আমি, শিবা আর আসলাম, তারপর বাকিরা, কেমন? বেশি আনসান মাস করবে না, কোথাও যেন দাগফাগ না পড়ে, হাড়কাটার মাল নয়…
গুউ, বওটা আমাকে দেবে? হেবি ইচ্ছে করছে।
সাপের মতই একটা হিসহিস আওয়াজ করে শিবার টুঁটিটা আঁকড়ে ধরে টেনি শালা, ঢ্যামনার শখ দ্যাখ বে! চল, একটা টুননিকে নিয়ে সাইডে ফুটে যাবি। আব্বে এ সামন্তের বাচ্চা, গদ্দা রেডি আছে তো? আর সাদা চাদর?
বলতে বলতে ওরা একতলায় উঠে আসে নিয়তির অমোঘ অভিশাপের মত। টেনিয়া শিবাকে বলে, খটখট কর, দরজা খুলতে বল। শিবা খটখট করতে করতে সুরে বলতে থাকে, রাত হল দোর খোলো খুকুমণি সোনারে, মাসুক এসেচে কত চোক। খুলে দেকো রে।
কোনো সাড়া আসে না, ধমকে ওঠে টেনিয়া, সর বে, ছড়া কেটে স্লা বাপের বিয়ে। দিচ্ছে। চল বে কান্ধা লাগা…
বলতে বলতে টেনিয়া এগিয়ে এসে শিবাকে নড়া ধরে তোলে। তারপর দুইজনে এগিয়ে ধাক্কা দিতেই দরজাটা যেন অলৌকিকভাবে হাট হয়ে খুলে যায় এবং তার ফলে হুড়মুড়িয়ে ওরা দুজনেই ভেতরে হুমড়ি খেয়ে চলে আসে। আর ঠিক তক্ষুণি যেন অলঙ্ঘনীয় ভবিতব্যের মতোই দরজাটা ওদের পিছনে সজোরে বন্ধ হয়ে যায়।
যদিও সেটা খেয়াল করার আগে ওরা সামনের দিকে তাকায় এবং চরম অবিশ্বাসে, সর্বগ্রাসী আতঙ্কে আর হাড়হিম করা ভয়ে স্থাণু হয়ে যায়।
সেই অর্ধেক আঁধার ঘরের মধ্যে, আধো চাঁদের আলো আর ল্যাম্পপোস্টের মৃত বিবর্ণ হলুদ আলো মিশিয়ে যেন প্রাগৈতিহাসিক এক সিলুয়েট তৈরি করেছে। আর তার মধ্যে ওরা দেখল তিনটি নগ্ন শরীর ঘরের মধ্যে বিচিত্র ভাবে দাঁড়িয়ে! বড় মেয়েটির ডান হাতে একটি ভয়ালদর্শন রক্তাক্ত খগ, আর তার মাথার জায়গাটা ফাঁকা! সেটা ধরা আছে তার নিজেরই বাঁ হতে! তার সেই কাটা গলা থেকে ঝরনার মতন ছিটকে উঠেছে তিনটি রক্তধারা। তার দুটি ধারা গিয়ে পড়ছে তার দুপাশে দাঁড়ানো বাচ্চা মেয়েদুটির মুখে, আর তৃতীয়টি নিজেরই কাটা মুটির মুখে। বড় মেয়েটির গলায় দুলছে নরকরোটির মালা, আর উদ্ধত দুই স্তনের মাঝে পৈতের মতন জড়িয়ে আছে একটি কুচকুচে কালো কেউটে! ঘরের মধ্যে উঠেছে এক চাপা ঘূর্ণি আর সেই প্রবল। হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে তাদের খোলা চুল, যেন দাউদাউ করে জ্বলছে নরকের কালো আগুন। বাচ্চা মেয়েদুটি চোখ খুলে পরম আবেশে পান করে যাচ্ছে সেই অঝোর ধারায় উৎসারিত রক্ত, তাদের হাতেও একটি করে ভীমকায় খগ, রক্তে ভেসে যাচ্ছে তাদের সমস্ত মুখ। রক্তস্নাতা সেই ভয়ঙ্করী দুজনকে দেখে মনে হচ্ছে যেন সাক্ষাৎ রক্তপিশাচী ডাইনি! দেওয়ালে, সিলিঙে জানালার কাঠে লেগে আছে তাজা রক্তের ছাপ। সারা মেঝে থইথই করছে রক্তে, যেন আজ বিশ্বচরাচরের সমস্ত রক্ত এই ঘরের মধ্যে।
আওয়াজ শুনে একসঙ্গে তিনটে মাথাই এদিকে ফেরে। রক্তমাখা মুখে সাদা দাঁত বার করে তিনটে মুখই খল খল খল করে একটু হেসে নেয়। তারপর যেন পাতালের গভীর থেকে, সমুদ্রের বুকের থেকে, আগ্নেয়গিরির আগুন থেকে উঠে এল এক প্রশ্ন, উচ্চারিত হল একই সঙ্গে তিনটি গলায়, কি রে, খাবি না? আমাদের খাবি না? আয়, খাবি আয়, এদিকে আয়, খেয়ে যা রে, আয় আয় আয়…
শোধ
ফজরের নামাজ সেরেই বেরিয়ে পড়েছিলেন আহমেদ খান। ভোপালের বর্তমান নওয়াব ঘাউস মহম্মদ খানের ওয়জির-এ-আজম মির্জা আজিজের বিশ্বস্ত সহচর আহমেদ খানের বয়েস আটচল্লিশ ও বাহান্নর মধ্যবর্তী ধূসর সীমারেখায়। ছোটো অবস্থা থেকে নিজ চাতুর্যে বিলক্ষণ প্রভাবশালী হয়ে ওঠা আহমেদ খানের বিশাল দৃষ্টিনন্দন হাভেলি, ছোটো কিন্তু আঁটোসাঁটো হারেম, অগণিত দাসী এবং কিছু অল্পবয়সি দাস, বেশুমার শরাব আর লাখনউভি বাইজি নাচের মেহফিল ভোপাল শহরের মধ্যে ইতিমধ্যেই বিশেষ প্রসিদ্ধ। তার ওপর স্বয়ং ওয়জির-এ-আজমের নৈকট্য যে ওঁর শান-ও-শওকতে চার চান্দ লাগিয়ে দিয়েছিল, এ নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। বিপুল প্রতাপে উনি ক্ষুদ্র মন্ত্রীপ্রতিনিধিসম আধিপত্যে সময় কাটাচ্ছিলেন, এমন অসময়ে এ হুজ্জত।