রাজারহাটের মেইন রাস্তা দিয়ে চলার সময় রিয়ার ভিউ মিররে আরেকবার মেয়ে তিনটের মুখ দেখলো শিবা। উত্তেজনা আর আশঙ্কায় সিটের সঙ্গে প্রায় লেপ্টে আছে ওরা। ওদিকে টেনিয়া ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছে, সেটা ওর আঙল মটকানো আর ঘনঘন ঘড়ি দেখা নিয়েই বোঝা যাচ্ছে।
প্রথম বড় সিগন্যাল থেকে গাড়িটা মসৃণ সড়ক ছেড়ে ডানদিকের অন্ধকারে খোয়া বিছানো রাস্তায় ধরতেই গাড়ির সঙ্গে মেয়ে তিনটিও দুলে উঠল। বড়ো মেয়েটা বলে উঠল, এত অন্ধকার কেন রাস্তায়? আমরা কোথায় যাচ্ছি? বোঝাই যাচ্ছে বিস্তর ভয় পেয়েছে। বাকি বাচ্চা মেয়ে দুটো আঁকড়ে ধরেছে বড়টার হাত। আধো অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে যে এদের মুখ ভয়ে আতঙ্কে সাদা বিবর্ণ হয়ে গেছে। টেনিয়া একটু কর্কশ গলায় বলে উঠল, আহ, সামনেই বিল্ডিং, ওখানেই পিসিমার ফ্ল্যাট। এত চেঁচামেচি করার কী আছে, অ্যাঁ?
মেয়েগুলো ধমক খেয়ে থতমত খেয়ে চুপ করে গেল। একটা হালকা ভয়ার্ত ফোঁপানির শব্দ শুনতে পায় শিবা। এরপর শক্তমুখে বাঁদিকে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে অন্ধকার বিল্ডিংটার সামনে দাঁড় করায় গাড়িটা।
এরপর একটা আর্ত চিৎকার।
সামন্তকে রাখাই হয়েছে ওই জন্যে অবশ্য। লোকটা আগে পার্টির জন্যে বোম বানাতো। একবার ভোটের আগে অপোজিশনের ছেলেরা ধরে মুখের অর্ধেকটা অ্যাসিড আর আগুনে পুড়িয়ে দেয়। দিনের বেলাতে দেখলেই বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে, রাত্তিরে তো কথাই নেই! রাত্তিরে অন্ধকারে দাঁড়ানো ট্যাক্সির জানালার পাশে এসে এইরকম আধপোড়া মুখ নিয়ে কেউ যদি হাতে আবছা হলুদ এমারজেন্সি লাইট ঝুলিয়ে বলে, নেমে আসুন, তাতে চমকে যাওয়া স্বাভাবিক। ওখানেই বাচ্চামেয়েগুলোর নার্ভ ফেল করতে শুরু করে।
এরা অবশ্য যখন থরথর পায়ে নেমে আসে, বাচ্চা মেয়েদুটো অলরেডি কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। বড় মেয়েটাকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে যে ওর পা কাঁপছে, যে কোনও মুহূর্তে পড়ে যাবে। বাচ্চা দুটো গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে পুরো। বড় মেয়েটা নেমেই বলল, আমরা এখানে থাকব না স্যাম, আমাদের স্টেশনে ফিরিয়ে দিয়ে এসো প্লিজ, দোহাই তোমার পায়ে পড়ি। আমাকে তো তুমি ভালোবাসো, তাই না স্যাম? প্লিজ স্যাম, লক্ষ্মীটি। আমরা কাল সকালে ঠিক কালীঘাটে পৌঁছে যাব, প্রমিস করছি। আমরা এর ভেতরে যাব না…
টেনিয়ার থাপ্পড়টা সাপের ছোবলের মতই নেমে এল মেয়েটার গালে। কোক করে একটা আওয়াজ তুলে মেয়েটা মাটিতে পড়ে গেল। বাচ্চা মেয়েদুটোর যেটা আছে, সেটা ভয় আর আতঙ্ক ছড়িয়েও অনেক বেশি কিছু; মনে হচ্ছে এদের পাগুলো যেন মাটিতে গেঁথে দেওয়া হয়েছে, এক্ষুনি পেচ্ছাপ করে ফেলবে।
ধীরে-সুস্থে নিচু হয়ে বড় মেয়েটার চুলের গোড়াটা খপ করে ধরল টেনিয়া, শুনে রাখ কুত্তি, টেনিয়ার ডেরায় ঢুকেছিস, তোদের সব নৌটঙ্কি এখন থেকে বন্ধ, বুঝলি? আজ রাতটা মস্তি, কাল শ্বশুরবাড়ি, বুঝেছিস? বেচাল যদি দেখেছি, টুকরো কত কেটে পুঁতে দেব। চেঁচালেও আশেপাশে শোনার কেউ নেই, দেখেনে চারিদিকে। ভালো। মেয়ের মত ঘরে বন্ধ থাক। কয়েকঘণ্টা পর কিছু দোস্ত নিয়ে আসছি, কিছু ফুর্তিফার্জা। হবে, ন্যাকড়াবাজি একদম নয়, ওকে বেব্বি? এখন চ্যল বে। বলে চুলের মুঠি ধরে। মেয়েটাকে দাঁড় করায় টেনিয়া। তারপর সিঁড়ি ধরে হেঁচড়ে তুলতে থাকে। মেয়েটাও বোধহয় চরম আতঙ্কে বোবা পাথর হয়ে গেছে। রেলিং ধরে ধরে উঠতে লাগল। ভিখ। আর সামন্ত বাচ্চাদুটোর ঘাড় ধরে টানতে শুরু করায় ওরাও এগোতে থাকে, বধ্যভূমির। দিকে টেনে নেওয়া বলির পশুর মতন।
দোতলায় উঠে ফ্ল্যাটের দরজা খোলে সামন্ত। তিনটি মেয়েকেই ঠেলে দেওয়া হয়। ভেতরে। টেনিয়া হিসহিসে গলায় বলে, এখানেই থাকো মামনিরা, ঘণ্টাতিনেক বাদে। তোমাদের কিছু আশিক জুটিয়ে আনছি, কেমন? আওয়াজ করলে কিচাইন হয়ে যাবে কিন্তু। এই সামন্তের বাচ্চা, খাবারদাবার যা দেওয়ার এদের দিয়ে দিও। আর তুমি কিন্তু সালা ময়দান ফকা দেখে গোল করতে যেও না, ঝিটনি দুটো খুলে হাতে ধরিয়ে দেবো, মনে থাকে যেন। চ্যল বে ভিখু! বলে টেনিয়া দ্রুত নেমে যায় সিঁড়ি বেয়ে।
রাস্তার ধারে লাগানো এক শীর্ণ ল্যাম্পপোস্ট থেকে ঘরে ঢুকে আসা ঘোলাটে মৃত আলোর মধ্যে ভূতগ্রস্ত মেয়ে তিনটেকে রেখে দরজা বন্ধ করে সামন্ত।
**********
রাত দেড়টা নাগাদ যখন বালুরঘাটের বিবেকানন্দ কলোনির দত্তগুপ্ত বাড়ির সামনে পুলিশের জিপটা এসে থামল, তখন শুধু দত্তগুপ্ত বাড়ি কেন, পুরো পাড়াটাই উত্তেজনা আর অমঙ্গল-আশঙ্কায় জুরো রুগির মতন কাঁপছে। জিপের আওয়াজ শুনে তাই দরজা। খুলে বেরিয়ে আসতে সময় নেননি তথাগত আর ঊর্মিমালা, আর তিতলির বাবা-মা। অতসীও সঙ্গেই ছিল। আশেপাশের বাড়ি থেকেও সটাসট দরজা খুলে উদ্বিগ্ন প্রতিবেশীরা। নেমে আসেন। দৌড়ে আসেন স্বর্ণালী আর রূপালীর মা বাবা।
জিপের সামনের সিট থেকে নেমে দাঁড়ানমধ্য চল্লিশের, পেটানো স্বাস্থ্যের দুই পুলিশ অফিসার। আর পেছনের সিট থেকে নেমে আসেন দুই মহিলা পুলিশকর্মী।
আর তারপর ধীর পদক্ষেপে, মাথা নিচু করে, বাড়ি থেকে পালানো তিন কন্যে।
আপনাদের মেয়ে নাকি? চওড়া হেসে বলেন প্রথম জন, আমি প্রবীর ব্যানার্জি, ওসি, সিআইডি স্পেশাল ব্রাঞ্চ। এই তিন মক্কেল শিয়ালদা স্টেশন চত্বরে ফালতু ঘোরাঘুরি করছিল। এই আমার কলিগ ওয়াসিম, ও গেছিল একটা পার্সোনাল কাজে, সন্দেহ হওয়াতে জিআরপিকে বলে তিনজনকে আটকায়। তারপর আর কী। আমাদের বস আবার এইদিককার লোক, আপনার ছাত্র ছিলেন। আপনার নাম শুনেই তিনি আর কোনও রিপোর্টের হ্যাঁঙ্গাম না বাড়িয়ে, জিআরপিকে বলে কয়ে আমাকে বললেন নিজে থেকে পৌঁছে দিতে। সেই ট্রেন ধরে এসে লোকাল থানা থেকে জিপ নিয়ে… একটু রাত হয়ে গেল বলে সরি…