অকম্পিত স্বরে ত্রিলোচন বললেন, না চিনি না।
ভারী হাতের একটা থাপ্পড় এসে গালে পড়তেই চোখে অন্ধকার দেখলেন তিনি, হিংস্র শ্বাপদের মতই গর্জন ভেসে এল, একদম মিথ্যা কথা বলবি না নোংরা হিন্দু।
এই জন্তুটা একটু আগে তোকে নৌকো করে পৌঁছে দেয়নি?– অতি কষ্টে চোখদুটো খুললেন ত্রিলোচন, রাগে, অপমানে মাথাটা আঁ আঁ করছিল। শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ক্রোধ সংবরণ করলেন তিনি, শান্তি, শান্তি, শান্তি, তিনবার বিড়বিড় করলেন। তারপর মাথা তুলে দৃপ্ত অথচ মৃদু স্বরে বললেন, বৃথাই গায়ে হাত তুলছ বিদেশি। আমি একে চিনি না। আমি দরিদ্র ব্রাহ্মণ, অন্য গায়ে। বেদপাঠের আমন্ত্রণে যাচ্ছি। অন্যায় কাজ করা তোমাদের মানায় না, হিন্দুদের শাস্ত্রকর্মে বাধা দিও না।
শব্দ করে ওঁর মুখে থুতু ছিটিয়ে দিল লোকটা, ঘেন্নায় কুঁকড়ে গেলেন উনি, শিব
শিব উচ্চারণ করে শিউড়ে উঠলেন।
তারপর চোখ খুলে সেই বিদেশি হানাদারকে কিছু বলার আগে চোখ গেল বিঘ্ননাশের দিকে, আর বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন তিনি।
ক্ষ্যাপা বাঘের মতই ফুলে উঠেছে বিঘ্ননাশ গাইতোণ্ডে। ঘাড়টা সামান্য উঁচু করে তীব্র লাল চোখ মেলে সে একবার এই বিদেশি সেনাধ্যক্ষকে দেখছে, আরেকবার। চারিদিকের সৈন্য সমাবেশকে।
আরেকবার ভয় পেলেন ত্রিলোচন, ছেলেটা উত্তেজনায় কিছু করে না বসে। আদিল শাহি সৈন্যদলে একটা ছোটখাটো দলের সর্দার ছিল বিঘ্ননাশ। চিৎপাবন ব্রাহ্মণ হলে কী হবে, সাহসে, শক্তিতে আর দৈহিক ক্ষমতায় শ্রেষ্ঠতম ক্ষত্রিয় সে, দুর্জয় সাহস এই যুবকের বুকে, আর তলোয়ার চালানোয় তো সে সাক্ষাৎ সিদ্ধপুরুষ।
এত কিছু খেয়াল করেনি সেই বিদেশি। একটানে তলোয়ারটা খুলে তার ডগাটা ত্রিলোচনের বুকে চেপে ধরে, একটানে ছিঁড়ে নেয় উত্তমাঙ্গের উত্তরীয়টি, তার পর ব্যঙ্গের হাসি হাসতে হাসতে খেলাচ্ছলেই সামান্য চালিয়ে দেয় তলোয়ারটা, ফিনকি দিয়ে সামান্য রক্ত বেরিয়ে আসে দক্ষিণ কোঙ্কণের সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বজনমান্য পণ্ডিত ত্রিলোচন ক্ষেমকল্যাণীর বুক থেকে। একটা অস্ফুট আর্তনাদই কি করে উঠলেন তিনি?
আর সেটাই বোধহয় কাল হল। ঘন গম্ভীর গলায় একটা ধমক ভেসে এল পেছন থেকে, নোংরা বিদেশি কুত্তা, দূরে সরে দাঁড়া। তোর সাহস হয় কী করে ওঁর অঙ্গস্পর্শ করার? তোর কী জিজ্ঞাসা করার আছে আমাকে কর। সাহস থাকে তো হাত দুটো খুলে একটা তলোয়ার দে না, তোদের কুকুরের মত লাথি মারতে মারতে কোপাতে কোপাতে দেশের বাইরে বার করে দিই…
ধীরেসুস্থে সেদিকে ফেরে সেই বিশালদেহী যবন সেনাপতি, ব্যঙ্গের সুরে বলে, এই। তো, পোষা কুত্তার মুখে বুলি ফুটেছে দেখছি।
পাশ থেকে আরও এক যবন সৈন্য একটা নোংরা ফুট কাটে, ভাঙা কোঙ্কণিতেই, খুব তেজ দেখছি ছোকরার। তুই সেই হিন্দু জানোয়ারটা না, যার বউকে তুলে এনেছিলাম আর বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে এসেছিলাম? তাই ভাবি, কবুতরি বিছানায় এত চেল্লায় কেন, এমন জোয়ান কবুতরের জুড়িদার বলেই না…
সহসা মহাকালসর্পের মতই ফণা তুলে দাঁড়ায় সেই মারাঠি যুবক, হিসহিস আওয়াজ করে বলে, হাত দুটো খুলে দে না রে বেজন্মার বাচ্চা, তোদের সিধে নরকের রাস্তাটা দেখিয়ে দিই। হারামজাদারা মেয়েদের আর নিষ্পাপ বৃদ্ধদের ওপরেই যত বীরত্ব দেখাতে পারিস দেখছি। কীসের দুধ খেয়ে বড় হয়েছিস রে নোংরা কীটের দল, তোদের মায়ের, না জংলি শুয়োরদের?
হেলেদুলে ধীরেসুস্থে বিঘ্ননাশের দিকে হেঁটে যেতে যেতে একটা কুৎসিত হাসি ভেসে ওঠে সেনাধ্যক্ষকের মুখে, শাব্বাশ, এমনই তো চাই। যখন তোর বউকে বিছানায় শুইয়ে ভোগ করছিলাম, সেও এরকমই তেজ দেখাচ্ছিল বটে, তবে কি না সে মাগির গুমোর ভাঙতে বেশ মজাই লেগেছিল। অবশ্য পুরো পল্টনের প্রসাদ হওয়ার পর বেশ্যা মাগিটার অত তেজ ছিল না। শ’খানেকের ভোগ হওয়ার পরেই তো পটল তুললাম শালি। আহা, এখন ভাবি অমন চাম্পিমাল বাঁচিয়ে রাখলেও হত, সময়ে সময়ে আমাদের পালা করে সেবা করতে পারত। হিন্দু ব্রাহ্মণের মেয়েগুলো বড় নরমসরম আহা… বেশ্যাগুলো বিছানা গরম করতেও…
এরপর আর সরেনি সেই কুৎসিত জিহ্বা। বোধহয় অতি উৎসাহিত হয়েই একজন সৈন্য ঘোড়ার মাথার কাছে সরে আসে এই সরস আলোচনা শুনতে, যে ঘোড়ার সঙ্গে বাঁধা রাখা হয়েছিল বিঘ্ননাশ গাইতোণ্ডেকে। মুহূর্ত, শুধু একটিমাত্র অসতর্ক মহর্ত, দক্ষ তলোয়ারবাজ বিঘ্ননাশ সামান্য ডানদিক ঝুঁকে, দুহাত বাঁধা অবস্থাতেই সেই অতি উৎসাহী বিদেশি সৈনিকের কোষ থেকে বার করে আনে দীর্ঘ তলোয়ারটি, আর সেই একই ভরবেগের সঙ্গে সমস্ত শরীর ডানদিক থেকে বাঁদিকে চালিত করে তরবারিটি গেঁথে দেয় বিদেশি সেনাপতিটির গলা বরাবর। ঘটনাটা ঘটে যায় চকিতের মধ্যে, কেউ কিছু বুঝে উঠবার আগেই। অত্যন্ত অবিশ্বাসের সঙ্গে নিজের গলার অর্ধেকটা অবধি গাঁথা তলোয়ারটা দেখতে দেখতে দুম করে মাটিতে পড়ে যায় সেই বিশালদেহী মানুষটি, আর সঙ্গে সঙ্গে একটা বন্দুকের আওয়াজ ভেসে আসে, মাথার অর্ধেকটা উড়ে যায় বিঘ্ননাশ গাইতোণ্ডের। রক্তে, ঘিলুতে, দীর্ণ খুলির ভগ্নাংশে আর টুকরো নরমাংসে ত্রিলোচনের সর্বাঙ্গ ভরে যায়, পুরো দৃশ্যটা এক ভয়ঙ্করতম অলৌকিক নারকীয়তা নিয়ে তার চৈতন্যে আঘাত করে।