সবাই কাছাকাছি পৌঁছাতেই মার্টিনহো থুতনির কাছে নেমে আসা সরু স্যাটকমের নেভিগেশনে আদেশ দিলেন ‘মুভ আপ।
পাহাড়ের গা ঘেঁষে যেন তেরোটা মাকড়সাই উঠে এল স্কুলের পিছনে ছোট্ট চাতালটায়।
.
১৫৬০। অগাস্ট। গোয়া।
ছোট নৌকাটা ঘাটে এসে থামতেই একটা মৃদু ধাক্কায় উঠে পড়লেন ত্রিলোচন। নৌকা থেকে লাফিয়ে হাঁটুজলে নেমে একটা গাছের শিকড়ের সঙ্গে বাঁধেবিঘ্ননাশ।একটা তক্ত। এনে পেতে দেয় নৌকা থেকে ঘাট অবধি, যাতে ঠাকুর নির্বিঘ্নে নেমে আসতে পারেন।
ঈষৎ স্থলিত পায়ে সেই তক্তা বেয়ে নেমে আসেন ত্রিলোচন ক্ষেমকল্যাণী। কোমরে হাতে দিয়ে দেখে নেন জিনিসটা ঠিকঠাক আছে কি না। তারপর আর্শীবাদ করেন বিঘ্ননাশকে। মাথা নিচু করে সেই আশীবাদ নেয় হতভাগ্য ছেলেটি, আর তারপর ফপিয়ে ওঠে, এই শয়তানগুলোর হাত থেকে কি আমাদের মুক্তি নেই জ্যেঠঠাকুর?
প্রশ্নটা তীরের মতন বুকে এসে বেঁধে ত্রিলোচনের। এই বিঘ্ননাশ গায়তোণ্ডেকে ছোটবেলা থেকে দেখছেন উনি। বিঘ্ননাশের বাবা দার্শিক ছিলেন ত্রিলোচনের বিশেষ প্রিয়পাত্র। তার সামনেই হেসেখেলে বড় হল ছেলে, বিয়ে করল পাশের পালিগাঁওয়ের বাদন্য মালশের মেয়ে জ্যোতিকে। আহা, জোড়ায় জোড়ায় যেদিন দুজনে এসেছিল। রুদ্রবেতাল মন্দিরে, প্রাণভরে ওদের আশীর্বাদ করেছিলেন তিনি।
কিন্তু তার বছর দশেক পরে ভিনদেশি যবনদের উৎপাত যখন আছড়ে পড়ল এই গোয়াপুরী সহ সমগ্র কোঙ্কণ অঞ্চলে, তার প্রথম ঝটকাটা যাদের ওপর দিয়ে গেল, তাদের একজন এই গাইতোণ্ডে পরিবার। বিঘ্ননাশ সৈনিক পুরুষ, আদিল শাহি সেনাদলে ছিল; তার ওপর তার রক্তও কিঞ্চিৎ বেশি গরম। বাজারে এক যবন সৈনিকের সঙ্গে সামান্য কথা কাটাকাটি হওয়াতে একদিন তারা দল বেঁধে বিঘ্ননাশকে ধরতে আসে। ছোকরা সেদিন কাজে অন্যত্র গেছিল। সেই যবন সৈনিকের দল বিঘ্ননাশকে না পেয়ে তার বাড়িঘরে আগুন দিয়ে দেয়, জোর করে ধরে নিয়ে যায় জ্যোতিকে। চিৎপাবন ব্রাহ্মণের কুলবধূকে বিদেশি যবন সৈন্য প্রকাশ্য রাস্তায় অর্ধউলঙ্গ করে চুল ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে, খুব সম্ভবত এই দৃশ্য দেখেই দার্শিক আর তার বউ লজ্জায়, ঘেন্নায় আতঙ্কে মারা যায়, বা হয়তো আত্মহত্যাই করে, সঠিক বলা যায় না। তাদের মরদেহদুটি সেই ঘরের সঙ্গে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে অবশ্য বেশি দেরি হয়নি।
বিঘ্ননাশ ক্রোধে উন্মাদ হয়ে একটা খোলা তলোয়ার হাতে সেদিনই ছুটে যাচ্ছিল প্রতিশোধ নিতে, তাকে আটকান ত্রিলোচনই। নইলে বন্ধুপুত্রের সেদিনই ইহলীলা। সাঙ্গ হত। সেই থেকে গোয়াপুরীর আরেকপ্রান্তে সঙ্গোপনে একে লুকিয়ে রেখেছেন ত্রিলোচন, এর কাজই হচ্ছে স্থানীয় তৃণমূল স্তরে ছেলেপুলেদের সংগঠিত করা এই বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে।ত্রিলোচনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোকেদের মধ্যে প্রথমেই থাকবে এই অগ্নিবর্ষী যুবা।
প্রিয় অনুচরের মাথায় হাত রাখেন ত্রিলোচন, নিজের হাতটাও সামান্য কেঁপে উঠলো কি? ফিসফিস করে বললেন, দিন বদলাবে বিঘ্ননাশ, অত্যাচারীর শাসন কখনও একটানা চলতে পারে না। স্বয়ং বেতাল মহারাজ সাক্ষী এই অনাচারের; তিনি সব দেখছেন, সব শুনছেন, তাঁর দরবারে পাপের শাস্তি ভয়াবহ মৃত্যু। তুমি তোমার কাজ চালিয়ে যাও বিঘ্ননাশ, আবার দেখা হবে।
এই বলে ঘন অন্ধকারের মধ্যেই পা ফেললেন ত্রিলোচন ক্ষেমকল্যাণী। আর দু ক্রোশ দূরেই কুশস্থলি, ঠিকঠাক হাঁটলে আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া উচিত। ভোরের আলো ফোঁটার আগেভাগেই পৌঁছতে হবে, আর তারপর কালভৈরব মন্দিরে। নাহ, অনেক কাজ বাকি। দ্রুত হাঁটা লাগান তিনি।
বেশিদুর অবধি অবশ্য যেতে হল না। আধঘণ্টাটাক হাঁটার পরেই রাস্তার পাশে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ শুনে ঝোঁপের আড়ালে আঁধারে মিশে গিয়েছিলেন ত্রিলোচন। কিছুক্ষণ পরেই মশাল জ্বালিয়ে পুরো এলাকাতে খোঁজ করা শুরু করে দেয় একগাদা যবনসৈন্য। ঝোঁপের আড়াল থেকে বলির পাঁঠার মতন কাঁপতে থাকা ত্রিলোচনকে খুঁজে বার করতে তাদের কোনই অসুবিধা হয় না। ত্রিলোচন সভয়ে দেখেন উনি একা নন ধরা পড়েছে বিঘ্ননাশও। তার দু হাত বেঁধে ঘোড়ার সঙ্গে হাঁটিয়ে আনা হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে যে এই অল্প সময়ের মধ্যেই তার ওপরে একটা ঝড় বয়ে গেছে, বাঁ চোখের নীচে কালশিটে, ঠোঁটের কষ বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে, চোখে সব কিছু গুলিয়ে যাওয়া উদভ্রান্ত দৃষ্টি।
রাতের অন্ধকারে ঝিল্লিমুখর সেই মধ্যরাত্রে যেন এক আসন্ন অশুভ নাটকের মুখ্য চরিত্র হিসেবেই বৃত্তাকারে সাজানো সেই সৈন্যদলের মাঝে দাঁড় করানো হয় ত্রিলোচনকে সৈন্যদলের অধিপতি লালমুখো বিশালদেহী মানুষটি সামনে এসে ভাঙা ভাঙা কোঙ্কণি ভাষায় জিজ্ঞেস করল, এই কালা নেংটি ইঁদুরের বাচ্চা, এই জন্তুটাকে চিনিস?
সর্বজনশ্রদ্ধেয় বেতালসিদ্ধপুরুষ ত্রিলোচন ক্ষেমকল্যাণীকে সমগ্র কোঙ্কণে কেউ এই ভাষায় সম্বোধন করতে পারে, এ ওঁর স্বপ্নেরও অগোচর। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলেন নিচু হওয়া মাথাটা সামান্য উঁচু করে লাল চোখ মেলে এই যবন সেনাপতিকে দেখছে বিঘ্ননাশ, ঠোঁট থেকে রক্তমেশা লালা গড়িয়ে পড়ল খানিকটা।
ভয় পেলেন ত্রিলোচন, নিজের জন্যে না, বিঘ্ননাশের জন্যে। বড় মাথাগরম ছেলে, খণ্ডমুহূর্তে প্রলয় বাঁধিয়ে দিতে পারে। কিন্তু এখন মাথা ঠান্ডা রাখা দরকার, একদম ঠান্ডা রাখা দরকার। জ