এই বলে বৃষ্টির মধ্যেই ঘোড়ায় চড়ে চলে যেতে থাকেন মনসেইনর রেভারেন্ডো, গোঁয়ার ভাইকার জেনারেল, মিগুয়েল ভাজ।
.
২০১৬। জুলাই। আফগানিস্তান।
স্কুলটা একটা উপত্যকার গা ঘেঁষেই। স্কুলের পিছনের চাতাল থেকে ঠিক বারো ফুট দূর থেকে পাহাড়ের খাদ শুরু। সেদিকে যাতে বাচ্চারা চলে না যায়, তার জন্যে স্কুল। বিল্ডিংয়ের দুপাশ দিয়ে বেশ কিছুটা দূর অবধি লম্বা চলে গেছে কাঁটাতারের ফেন্সিং। উপত্যকার ওপারে হিন্দুকুশ রেঞ্জের অপার্থিব নয়নাভিরাম দৃশ্য। দূর, অতি দূর অবধি। ঢেউ খেলে গেছে পাহাড়ের সারি। মাথায় মাঝে মাঝে মেঘেদের আনাগোনা।
কিন্তু আজ এই অপার্থিব দৃশ্য দেখার সময় কারো নেই, একটা নিঃসীম বীভৎসতার আশঙ্কা যেন কালো ডানা মেলে নেমে আসতে চাইছে পুরো এলাকাটা জুড়ে।
স্কুলের সামনের দিকে অনেকটা জায়গা জুড়ে দীর্ঘ উপবৃত্তাকার এলাকা কর্ডন করে। রেখেছে আফগান ন্যাশনাল পুলিশ। খবর পেয়েই আফগান আর্মির টু হান্ড্রেড নাইন্থ কর্পস এসে উপস্থিত। বড় বড় পুলিশ ভ্যান আর জিপ, আফগান আর্মির কমব্যাট, ভেহিকল, সার্চ লাইটের আলো, স্থানীয় কিছু সংবাদদাতা সংস্থার ভ্যান, এর পিছনে বুকচাপড়ানো আফগান মায়েদের দল, আর হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে তাদের সামলে রাখা আফগান বাবাদের ভিড়, রঙ্গ দেখতে আসা ইতর জনগণ– সব মিলিয়ে নরক গুলজার হয়ে রয়েছে জায়গাটা। খবর পেয়ে সিএনএন আর বিবিসির স্থানীয়। সংবাদদাতারা বিশাল বিশাল ছাতাওয়ালা ভ্যান নিয়ে এসে হাজির। আস্তে আস্তে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সারা দুনিয়াতে ছড়িয়ে যাচ্ছে এই সর্বনাশা খবর। আতঙ্কে, ঘেন্নায়, শিউরে উঠে নিঃশ্বাস বন্ধ করে পৃথিবী অপেক্ষা করছে আরেকটা নৃশংস গণশিশুহত্যার জন্যে, বেসলান আর পেশওয়ারের পর। আরেকটা!
পুলিশ আর আর্মির সঙ্গে জঙ্গিদের প্রাথমিক আলোচনা ব্যর্থ। তার প্রধান কারণ জঙ্গিরা নির্দিষ্ট করে কিছু চায় না। তারা শুধু দেখাতে চায় আল্লাহর সৈনিকরা কতটা। অকুতোভয়। পৃথিবীতে শরিয়ত কায়েম করার জন্যে তারা কত বৃহৎ আত্মত্যাগের নজির রাখতে পারে। স্থানীয় জিরগার এক বৃদ্ধ প্রধানকে ডেকে আনা হয়েছে কথাবার্তা চালিয়ে যাবার জন্যে। তিনি পুলিশের মাইকে জঙ্গিদের কাছে উচ্চৈঃস্বরে আবেদন জানাচ্ছেন শান্তিপূর্ণ ভাবে আত্মসমর্পণের জন্যে, ইসলামে নরহত্যার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সুরা আর আয়াত পেশ করছেন, নাবালগ শিশুদের প্রাণের জন্যে দোহাই পাড়ছেন, নিজেকে জিম্মি রাখবার প্রস্তাব দিচ্ছেন, বলছেন দরকার হলে তাকে ছিঁড়ে হাজার টুকরো করুক জঙ্গিরা, কিন্তু শিশুদের যেন কিছু না হয়…
উত্তরে মাঝে মাঝে শুধু বুলেট ছুটে এলে তৎক্ষণাৎ লোকজন নিচু হয়ে প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। কিছুক্ষণ পরে পরে সেই একই নাটক। জিরগার বৃদ্ধ প্রধান হাউহাউ করে কাঁদছেন, আর শিশুদের জীবনের ভিক্ষা চাইছেন। পুলিশের কাজ আরও শক্ত হয়ে উঠছে বাবাদের জন্যে। জোয়ান আফগান রক্ত, জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্যেরই সমান, সবারই দাবি দুটো বন্দুক দিলে তারাই এই শয়তান গুলোকে নিকেশ করে আসতে পারে।
হায়রে বাবাদের মন!
ঘনঘন ঘড়ি দেখছিলেন দোয়াহম ব্রিডমান, অর্থাৎ লেফট্যানেন্ট শের আবদুল বারি করিমি। অনেকক্ষণ হল খবর পাঠানো হয়েছে ল্যামেগোতে, জার্মানদের মাধ্যমে। কোনো সাড়াশব্দ নেই কেন?
এমন সময় ওঁর জিপ থেকে নিজস্ব সর-বাজ, অর্থাৎ প্রাইভেট সার্জেন্ট দিলবার নজারি ওয়াকিটকিটা নিয়ে দৌড়ে এল। সেটাকে কানে চেপে দূরে সরে যান কুশলী ও ধূর্ত লেফট্যানেন্টটি, বলখ প্রদেশের টু হান্ড্রেড নাই কপসের প্রধান আবদুল করিমি। খানিকক্ষণ পরে মুখে একটা হালকা স্বস্তির ভাব ফুটে উঠল তার। ওভার অ্যান্ড আউট বলে সিগন্যাল কেটে দিলেন।
এইবার পালটা লড়াই শুরু।
দ্রুত উনি আর্মি ও পুলিশের কাছে এগিয়ে আসেন, বলেন সামনের দিকটায়। আরো অ্যাকটিভিটি বাড়াতে। নেগোশিয়েশন চালিয়ে যেতে বলেন আরো জোরদার। ইতিমধ্যে মাজার-ই-শরিফ আর কুন্দুজের দুই সম্মানীয় বৃদ্ধ উলেমারা এসে হাজির। তাদেরও হাতে মাইক দিয়ে আরো কিছু সার্চ লাইট জ্বেলে দেওয়া হল। ইতিমধ্যেই বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে জায়গাটা।
স্কুলের সামনের দিকেই ওদের টেনে আনতে হবে। যাতে পেছন দিকটা ফাঁকা থাকে!
এদিকে স্কুলের পিছন দিকের উপত্যকার পাহাড়ের গা ঘেঁষে, স্পেশাল হারনেস। বেঁধে, টিকটিকির ক্ষিপ্রতায় পাশাপাশি সরে সরে স্কুলের পেছন দিকে পাহাড়ের গায়ে জড়ো হচ্ছে তেরোজন রেঞ্জার্স যারা প্রত্যেকেইউ এস কলোরাডোর ফোর্ট কারসন, স্পেশাল ফোর্সেস মাউন্টেন অপারেশনস স্কুল থেকে বিশেষ ট্রেনিংপ্রাপ্ত। চৌকো শক্ত চোয়াল, ভাবলেশহীন মুখ। প্রত্যেকের পিঠে ঝুলছে পঁচিশ কিলোর অপারেশনস লোড।
প্রত্যেকের কাছে আছে হেকলার অ্যান্ড কোখের দুটো করে হ্যান্ডগান, একটা করে উজি সাবমেশিনগান। মেইন কমব্যাট ইন্সট্রুমেন্ট যদিও সিগ সয়েরের এসজি ৫৪৩ অ্যাসল্ট রাইফেল। এর সবকটাতেই অটোমেটিক সাইলেন্সর লাগানো। পর্যাপ্ত অ্যামুনিশনস পিঠে ও টাইট ব্ল্যাক ইউনিফর্মের বিভিন্ন খাঁজে।
আর প্রত্যেকের দুই হাঁটুর কাছে লুকিয়ে আছে দুটি করে গ্লকা বি-ওয়ান ওয়ার নাইফ। শুধু এই ওয়ার নাইফ দিয়ে এই তেরোজন রেঞ্জার্স হ্যান্ড টু হ্যান্ড ক্লোজ লড়াইতে কমসেকম পঞ্চাশ থেকে সত্তর জনের মহড়া নিতে পারে। সারা মুখ কালো কাপড়ে জড়ানো, শুধু চোখ আর নাক ছাড়া।