উনি অবশ্য এদেশে এসেছেন বিশেষ কাজে, পোপের আদেশে। সে আদেশের বিন্দুবিসর্গ পোপ ছাড়া আর কেউ জানে না, সম্রাট অবধি না!
আজ থেকে দশ বছর আগে স্বয়ং পোপ ওঁকে বিশেষ আদেশবলে ডেকে পাঠান। এক বিষণ্ণ বর্ষণক্লান্ত বিকেলে সেই সংক্ষিপ্ত আলাপ এখনো মনে আছে ওঁর।ভ্যাটিকানের এক রুদ্ধকক্ষে, এক সান্ধ্য আলাপের আসরে মিলিত হয়েছিলেন দুজনে, টেবিলের ওপর খোলা ছিল একটি শতাব্দী প্রাচীন বৃহৎ বই। আকারে ইঙ্গিতে অনুমান করেছিলেন। তিনি, ভ্যাটিকানের সবচেয়ে সুরক্ষিত ভল্ট থেকে তুলে আনা এই বইটি। যে ভল্টে একমাত্র স্বয়ং পোপ ছাড়া আর কারো প্রবেশাধিকার নেই। উৎকৃষ্ট বেলজিয়ান সুরা পানের পর পোপ চতুর্থ পায়াস একটি বিশেষ কাজের ভার তাঁকে দিয়েছিলেন, বইটির রেফারেন্স দিয়ে।
কাজটা আর কিছুই না, পশ্চিম ইন্ডিয়াতে, যেখানের রাস্তা সবে উন্মুক্ত হয়েছে, সেখানকার একটি বিশেষ স্থানে নাকি একটি অতিপ্রাকৃতিক আধিদৈবিক মহাশক্তির। আধার আছে, সেটি তুলে এনে পোপের হাতে সমর্পণ করতে হবে। এই পোপ না। হোক, পরের পোপ। এইটাই আদেশ, এবং সম্রাট তৃতীয় জন যেন এর বিন্দুমাত্র আঁচ না পান। এ আদেশ অমান্য করার ক্ষমতা বা ইচ্ছা, কোনোটাই অবশ্য ওঁর ছিল না। কারণটা বক্তব্যের আসল জায়গাটা তিনি ঠিকই বুঝেছেন, এই পোপ না হোক পরের পোপ!’ মানে ইচ্ছেটা পোপ চতুর্থ পায়াসের ব্যক্তিগত নয়, সমগ্র খ্রিস্টান ধর্মজগতের, এবং পরিকল্পনাটি আজকের নয়, বেশ অনেকদিনের। এ কাজে অনেক সাহস করেই হাত দিতে হয় এবং শেষমেশ এই পোপই দিয়েছেন। তার অবশ্য কারণ আছে। ইনি অতি প্রতাপশালী লোক, শুধু পোপই নন, ইতালির মহাক্ষমতাধর মেদিচি পরিবারের। সন্তানও বটে।
তা এই মহাশক্তিধর ব্ল্যাক মাজিক আর্টিকেলটির খোঁজ হিজ হোলিনেস পোপ। পেলেন কী করে? এ প্রশ্নও করেছিলেন তিনি, জবাবে পোপ মৃদু হেসে সামনে। খোলা বইটির প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন। কী বই, কার লেখা, কী বৃত্তান্ত, এ নিয়ে আর কৌতূহল দেখাননি তিনি। পোপের মৃদু অনুরোধ খ্রিস্টীয় অনুশাসনের যে কোনো সৈনিকের কাছে কালান্তক আদেশের সমান। তিনিও আর প্রশ্ন করেননি, একশো বছরে। আগে জারি করা পোপ পঞ্চম নিকোলাসের আদিষ্ট ‘প্যাপাল বুল রোমানস পন্টিফে’ বা পোপের বিশেষ আদেশ নিয়ে সোজা এখানে এসে ঘাঁটি গেড়েছেন।ইতিমধ্যে পদোন্নতিও। ঘটেছে ওঁর, গোয়াতে পোর্তুগীজ রাজত্ব স্থাপন করার ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার জন্যে পোর্তুগালের রাজদ্বারে বিপুল প্রতিপত্তি জুটেছে তার, কিন্তু পোপের আদেশ ভোলেননি। তাই প্রথম সুযোগেই ইনি এখানে। তারপর তন্নতন্ন করে খুঁজে, লক্ষণ মিলিয়ে, অজস্র উপকথা আর জনশ্রুতি শুনে আজ যখন তিনি সেই বহু আকাঙ্খিত স্থানে এসে উপস্থিত, তখন দেখছেন যে, যার জন্যে এতো প্রাণপাত, সেই জিনিসটিই ফুড়ুৎ!
মূর্তির পাদদেশে একটি ছোট চৌকো পীঠস্থান মতো আছে। তার ওপরেই এই পাথুরে মূর্তিটি। হিসেবমতো তারই মধ্যে বিশেষ প্রকৌশলে লুকোনো থাকার কথা সেই পোপের আদিষ্ট মহাশক্তিধর জিনিসটির। উনি প্রস্তুত হয়েই এসেছিলেন, দরকার পড়লে পীঠস্থানটি খুঁড়ে দেখবেন বলে।এখন বোঝাই যাচ্ছে যে তার আর দরকার নেই। কারণ চৌকোনা পীঠস্থানটির সামনে একটি ছোট্ট চৌকো গহ্বর খালি। বোঝাই যাচ্ছে যে ওখানে বহু যত্নে কিছু লুকিয়ে রাখা ছিল, হয়তো বহু প্রাচীন কাল থেকে এবং এখন আর নেই! চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে মনসেইনর রেভারেন্ডোর। চোখদুটো একটু সরু হয়েই স্বাভাবিক হয়ে যায়।
এই জিনিসের খোঁজ একজনের পক্ষেই জানা সম্ভব, সেই-ই সরিয়েছে জিনিসটা। একটা শীতল ক্রোধ ওঁর মেরুদণ্ড বেয়ে মাথায় উঠতে থাকে।
এই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত কোথায়? তাকে আমার চাই, এক্ষুনি, যে করে। হোক, সেই পাথুরে মন্দিরের মধ্যে গমগম করতে থাকে ওঁর স্বর।
দীর্ঘদেহী রাজপুরুষটি একটু সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে আসেন, ইয়ে একটা ছোট অসুবিধা হয়েছে মনসেইনর। আমি আদেশ দিয়েছিলাম প্রধান পুরোহিত, আর তার পরিবারকে বন্দি করতে। দুভার্গ্যজনকভাবে প্রধান পুরোহিত কোনোভাবে টের পেয়ে পালায়। আমরা অবশ্য তার স্ত্রী আর ছেলেকে আটক করেছি, ফোর্ট আঞ্জেদিভেতে বেঁধে রেখেছি দুজনকেই, দুজনের ওপরেই ইন্টারোগেশন চলছে। একটু দম নিয়ে নেন তিনি, আর অলরেডি এক প্ল্যাটুন সোলজার পাঠিয়েছি লোকটাকে ধরে আনতে। সৌভাগ্যক্রমে আমরা জানতে পেরেছি, লোকটা কোর্টালিম যাচ্ছে। আশা করছি আজ রাতের মধ্যেই লোকটাকে ধরে কাল সকালে আপনার সামনে হাজির করতে পারব, রেভারেন্ডা।
ভ্রুকুটিকুটিল চোখে খর্বকায় লোকটি পেছন ফিরে তাকান, আপনি কী করে এত নিশ্চিত হচ্ছেন, সেইনর?
দীর্ঘদেহী রাজপুরুষটি ধূর্ত হাসি হেসে বলেন, আমরা জানতে পেরেছি যে, লোকটা নিজের ছেলেকে পাগলের মতন ভালবাসে। আজ না হয় কাল, ওকে ফিরতেই হত মনসেইনর।
আচ্ছা? খুব ভালবাসে? একটা নিষ্ঠুর ক্রুর হাসি খেলে যায় সেই প্রতাপশালী রাজপুরুষটির মুখে, কাল বিকেলে, তিনজনকেই বেঁধে আনবে, এই মন্দিরের সামনে। পুট দেম টু ডেথ, ডেথ বাই ফায়ার। এক্সিকিউশনের আদেশ কাল সকালেই আমার কাছ থেকে নিয়ে নেবেন সেইনর।
বলে, মন্দির থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে একটু থামেন তিনি, মেক শিওর দ্যাট হি সিইজ হিজ সন ডায়িং।অলসো মেক ইট শিওর দ্যাট দ্য এন্টায়ার ভিলেজ ইজ প্রেজেন্ট ডিউরিং দ্যাট টাইম। আমাদের একটা কড়া উদাহরণ রাখতে হবে। লোকে যেন বোঝে। মহান করুণাময় যিশুর পথে চলার শাস্তি কী। বলে একটু থামেন তিনি, তারপর যোগ করেন, দে নিড টু পে আ প্রাইস, আ ভেরি হেভি প্রাইস, বাই ব্লাড় অ্যান্ড ডেথ।