দেশীয় দুজন যেন একটু কেঁপে ওঠে সেই আওয়াজে। তবুও ধীরে ধীরে চাতালে ওঠে ওরা। চওড়া পাথুরে চাতাল পেরিয়ে যায় ভারী পা দুটো টেনে টেনে। পেছনে। বিদেশি হানাদারদের দল, আর সেই রাজপুরুষ দুজন। কয়েক পা হাঁটা, তারপর কাঠের সেই ভারী দরজা।
দরজায় কোনো আগল নেই, এমন কি বন্ধ করার কোনো ব্যবস্থাই নেই। কারণ। অন্ধকারে চুপিসারে রুদ্রবেতালের মন্দিরের চাতালে ওঠার, বা দরজা খোলার দুঃসাহস শুধু আমোনা গা কেন, গোটা বিচোলিম তালুকা, এমনকি সমগ্র দক্ষিণ কোঙ্কণে কারও নেই। হিন্দুধর্মে বহু দেবদেবীর পূজা হয়, কিন্তু সমগ্র ভারতে বেতাল শুধু মাত্র এইখানেই। পূজিত হন রুদ্রবেতাল রুপে, দেবাদিদেব শিবের অনুচর হিসেবে। একমাত্র মহাতন্ত্রধারক, অঘোরীদীক্ষিত, বেলসিদ্ধ প্রধান পুরোহিত ছাড়া এই মন্দিরের দরজা কেউ খোলে না। প্রধান পুরোহিতের অনুমতি ছাড়া কেউ চাতালে ওঠে না, পূজার্চনাও করতে আসে না। এই বেতাল মহাভয়ঙ্কর, মহাক্রোধী, স্বয়ং মহাকাল, পূজার্চনার তিলমাত্র ত্রুটিতে মহাঅনর্থ উপস্থিত হয়।
ধীরে ধীরে মানুষের হাতের ধাক্কায় খুলে যায় সেই প্রাচীন কাঠের বিশাল দরজা। সঙ্গে সঙ্গে তুমুল বজ্রপাত হয় কাছেপিঠেই কোথাও। সকলে সচকিত হয়ে ওঠে। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা ধেয়ে আসে চারিদিক জুড়ে। কঁপাকাঁপা পায়ে ভেতরে প্রবেশ করে দেশীয় দুইজন, প্রায় তৎক্ষণাৎ হুড়মুড় করে ভেতরে ঢোকে বাকিরা। ঢুকেই দরজাকবাট বন্ধ করে দেয় কেউ।
মশালগুলো তুলে ধরো কড়া গলায় আদেশ দেন দীর্ঘদেহী রাজপুরুষটি। এই গর্ভগৃহে কোনও জানলা নেই। তাই ফুল, তেল, অগুরু, সিঁদুর আর রক্তচন্দনের চাপা গন্ধে ভরে আছে ভেতরটা। চারিদিকে নিকষ কালো দেওয়াল, যেন খেয়ে ফেলবে। অনধিকার প্রবেশকারীদের! আর সব কিছু ভেদ করে, ওপাশের দেওয়ালে বিশাল একটা অবয়ব।
.
আস্তে আস্তে মশাগুলো ওরে ওঠে। কাকা। হাতে কয়েকজোড়া বেয়নেটও। বেতালমূর্তি প্রকটিত হয়।
মুহূর্তে দেশীয় দুইজন সাষ্টাঙ্গে প্রণিত হয় মুর্তির সামনে। উচ্চৈঃস্বরে স্তবমন্ত্র আওড়াতে থাকে। লালরঙের মেটে সিঁদুর, যজ্ঞভরে কালি আর এরও তেল। মাখানো ভয়াবহ সেই মূর্তির সামনে বিদেশিরাও একটু ঘাবড়ে যায় প্রথমে। সবাই বুকে হাত দিয়ে ক্রুশচিহ্ন আঁকে। দীর্ঘদেহী রাজপুরুষটি অস্ফুটে বলে ওঠেন মাই গড। কী ভয়ানক দেখতে এদের দেবতা। নরক থেকে উঠে এসেছে মনে হয়, কী বলেন। মনসেইনর রেভারেন্ডে?
অপেক্ষাকৃত খর্বকায় দ্বিতীয় রাজপুরুষটি এতক্ষণ তীক্ষ্ম দৃষ্টি মেলে মূর্তিটাকে দেখছিলেন। ভয়াবহ-ই বটে। বেলেপাথরের তৈরি মূর্তি, ফুট দশেক মতন লম্বা। চোখের দিকে তাকালে ভয় করে, পাথরের চোখে এত ক্রুরতা আর ভয়াবহতা ফুটিয়ে তোলা যায়। কে জানত? ওস্তাদ স্কাল্পটর, মানতেই হবে! তার ওপর অস্বাভাবিক বড় কান দুটি, তাতে আরো ভীতিজনক দেখায় মূর্তিটিকে। তবে যেটা আশ্চর্যজনক লাগল ওঁর কাছে, সেটা হলো দাড়ি। গত কয়েকবছরে অনেক জায়গায় অনেক হিন্দুমূর্তি দেখেছেন উনি, কিন্তু কোনো মূর্তিরই দাড়ি ছিল না। এখানে আছে। মূর্তির ডান হাতে একটা পাথরের দণ্ড বা স্টিক, বাঁ হাতটা কিছু নেবার ভঙ্গিতে এগোনো, মুঠি করা। দুটি পায়ে বেয়ে দুটি সাপ উঠছে। তবে মূর্তির সবচেয়ে কদর্য অংশ হচ্ছে দীর্ঘ, অনাবৃত লিঙ্গটি।
বিরক্তিতে ও বিবমিষায় গা গুলিয়ে ওঠে ওঁর। হোলি জিশাস, মনে মনে বিড়বিড় করেন উনি।এইসব ফিলদি, আগলি ডেমনদের পুজো করে এই নোংরা লোকগুলো? এ তো সাক্ষাৎ শয়তানের প্রতিমূর্তি। বিড়বিড় করতে করতে বুকে ক্রুশ আঁকেন তিনি। তিনি স্বয়ং উপস্থিত থাকতে এই ইন্ডিয়ান পিশাচগুলো এইভাবে জাহান্নমের রাস্তায় এগিয়ে যাবে? এই সব নিচু, অপরিষ্কত, অবিশ্বাসী ইন্ডিয়ানদের উদ্ধার করে প্রভু যিশুর রাস্তায় নিয়ে আসার জন্যই তো ওঁরা এই গড ফরসেকেন ল্যান্ডে এসেছেন। বিপথগামীদের উদ্ধার করাই তো একজন ক্রাইস্টের সেবকের জীবনের চরমতম ব্রত। তাই তো কষ্ট করে পোপ পঞ্চম নিকোলাসের প্যাপাল বুল রোমানাস হাতে নিয়ে, সম্রাট তৃতীয় জনের। আদেশ শিরোধার্য করে, প্রভু যিশুর প্রেমের পথে সবাইকে টেনে নিতেই ওঁর আগমন এই গোয়াতে! তার রাস্তায় যদি কেউ বিন্দুমাত্র বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তা হলে তাকে বা তাদের সমূলে উচ্ছেদ করতে উনি বদ্ধপরিকর। এ বিষয়ে উনি বজ্ৰাদপি কঠোর। অনিচ্ছুক পতিত লোকজনকে উদ্ধার করে প্রেমের প্রভু যিশুর পথে আনতে গেলে একটু রক্তপাত তো হবেই। স্থানীয় সমস্ত শয়তান পুতুলদের পুজো বন্ধ না করলে প্রভু যিশুর বার্তা প্রচার করা বড় কঠিন হয়ে পড়ে যে! তার ওপর আবার পুতুলপুজো থেকে মন না সরালে। ক্রুশপুজোতে মন দেবে কী করে এরা? সম্রাট বা পোপ কি তা সইবেন?– পোর্তুগালের রাজদরবার ছেড়ে আসার সময় দরবার রাজনীতির গতিপ্রকৃতি ওঁর নজর এড়ায়নি। সম্রাট তৃতীয় জন-এর বয়েস হয়েছে। এর পর, অঘটন কিছু না ঘটলে সম্রাট হবেন সেবাস্টিয়ান। অবশ্য বকলমে রাজত্ব থাকবে রানি ক্যাথারিনের হাতেই, সে নিয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়। ইনি আবার জেসুইটদের একনিষ্ঠ সেবক, মানে। চলবেন তাদের কথাতেই। মনে মনে একটা বাজে গালি দেন মহিলার উদ্দেশ্যে, বুড়ি যেমন গোঁড়া, তেমনই বোকা। সে যাই হোক, মালিক বা মালকিন বোকা হলে সবারই সুবিধা। কিন্তু পোর্তুগালের রাজদণ্ডটির নীচে পাকাপাকিভাবে মাথা গুঁজতে গেলে কিছু একটা তো করে দেখাতে হয়! এখন এই বাজারে পড়ে থাকে দুটিমাত্র কাজ, এক, নতুন দেশ জয়, যা খুবই পরিশ্রমসাধ্যকাজ! ইনি আবার তলোয়ার কেন, চামচ ছাড়া কিছুই। নাড়াতে জানেন না। সেক্ষেত্রে, তদভাবে দ্বিতীয় পন্থা, বিজিত নতুন দেশে খ্রিস্টধর্ম প্রসারণ, আর কী? তলোয়ার আর খ্রিস্টধর্ম, এ ছাড়া সম্প্রসারণ করার মতন ইওরোপের আর আছেটা-ই বা কী এখন?