জর্জি, কথাগুলো… মানে এখনও অবধি যা যা বলেছ সবই কি সত্যি?
আমি এ বিষয়ে একদম নিশ্চিত লিও, দৃঢ়স্বরে উত্তর দেন জর্জিনহো, আর এতদিন ধরে এ বাড়িতে আছো, তোমার তো এগুলো আমার থেকে বেশি জানার কথা। প্রতিটি পুরুষে প্রথম সন্তানের মৃত্যু তো আর আজগুবি হতে পারে না। আশা করেছিলাম এটুকু তুমি বুঝবে।
কিন্তু… কিন্তু সেগুলো তো দুর্ঘটনাবশতও হয়ে থাকতে পারে জর্জি, বা দুর্ভাগ্যজনক সমাপতন। হতে পারে না? যেন সমস্ত ব্যাপারটা থেকে কোনোভাবে যাবতীয় অলৌকিক ছোঁয়াচ অস্বীকার করতে পারলেই বাঁচে লিওনার্দো, এমনই আকুতি তার গলায়।
হেসে ফেলেন জর্জিনহো, না লিও। এতগুলো ব্যাখ্যাতীত মৃত্যু কোনোভাবেই সমাপতন হতে পারে না। আর সে ব্যাপারে পাক্কা প্রমাণ আমার কাছে আছে। সেই প্রমাণ হাতে আসার পরই আমি এই কাজে নেমেছি।
কী প্রমাণ জর্জি?
মিগুয়েলের ডায়েরি।
এরপর অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকে দুই ভাই। গলানো সীসের মতন কালো হ্রদের জলে বৈঠার ছপছপ আওয়াজ তুলে এগিয়ে যেতে থাকে ছোট্ট নৌকাটি।
মিগুয়েলের ডায়েরি এ পরিবারে প্রায় প্রবাদের মতন। সবাই জানে ডায়েরিটার। ব্যাপারে, কিন্তু সেটা কোথায় আছে কেউ জানে না। শুধু জানে যে মিগুয়েলের সময় থেকেই ভাঁজ পরিবারের প্রথম সন্তানের নিহত হওয়ার দুর্ভাগ্যজনক কাহিনিটি শুরু হয়। মৃত্যুর আগের দিন মিগুয়েল ভাঁজ বলে যান যে তার ডায়েরিতে এই অভিশাপ থেকে মুক্তির উপায় লেখা আছে এবং তিনি এটি বাড়িতেই কোথাও লুকিয়ে রেখে যাচ্ছেন যাতে কি না, একমাত্র উপযুক্ত সময়েই ইহা ঈশ্বরেচ্ছায় প্রকাশিত হয় এবং উপযুক্ত অধিকারীর পথপ্রদর্শক হইতে পারে।
ছোটবেলা থেকেই এ নিয়ে খোঁজখবর শুরু করে জর্জিনহোই। তখন থেকেই তার ব্ল্যাক ম্যাজিক, তন্ত্রমন্ত্র, অপদেবতার আরাধনা, গ্রিমোয়ার এসব নিয়ে প্রবল উৎসাহ। বলা বাহুল্য, গোঁড়া খ্রিস্টান ভাঁজ পরিবারে কেউই এসব ভালো চোখে দেখত না। কিন্তু অসম্ভব জেদি ছেলেটি তার লক্ষ্য থেকে একচুলও সরেনি। ধীরে ধীরে কৈশোরেই তার। মধ্যে বেশ কিছু অতিপ্রাকৃতিক শক্তির প্রকাশ ঘটে। সামান্য খ্যাপাটে, মুখচোরা এবং অসম্ভব গম্ভীর ছেলেটিকে এড়িয়ে চলতে থাকে সহপাঠীরা এবং কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষকরাও। এতে করেও চলে যাচ্ছিল যা-হোক না হোক। কিন্তু এক ক্রিসমাসের ছুটি হওয়ার আগের দিন তাদের এস্কোলা বা স্কুলে একদিন যা কাণ্ড ঘটায় সে, ভাবলে লিওনার্দো। এখনও শিউরে ওঠে। তার পরেই ঘর ছাড়তে হয়ে জর্জিনহোকে, আর সেইদিনই তার। ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়ে যায়।
লিওনার্দো তখন অনেক নিচু ক্লাসে পড়ে, জর্জিনহোর পড়ে সেকুন্দারিয়া, মানে। উঁচু ক্লাসে, তখন তার বয়েস ষোলো।
সব ক্লাসেই কিছু বখাটে গুন্ডা গোছের ছেলে থাকে, কিন্তু জর্জিনহোর ক্লাসে এমন তিনজন ছিল, তাদের মূর্তিমান শয়তান বললে কম বলা হয়। রাস্তায় মারপিট করা থেকে শুরু করে গোপনে মাদক সেবন করা, পতিতালয়ে রাত কাটানো- এসবই তাদের কাছে ছিল জলভাত। আর তাদের প্রিয় ব্যসন ছিল নিরীহ ছেলেছোকরাদের একলা পেলে হেনস্থা করা। মারধোর থেকে শুরু করে জঘন্য মানসিক নির্যাতন, কিছুই বাদ যেত না। এমনকি নতুন শিক্ষকরা অবধি এদের সমঝে চলতেন। এদের বিরুদ্ধে ভূরি ভূরি নালিশ কর্তৃপক্ষের কাছে জমা পড়লেও কোনই ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, কারণটা অবশ্য সহজেই অনুমান করা যায়।তিনজনের বাবাই ছিলেন শহরের বিত্তশালী ব্যবসায়ী বা প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তা।
সারা স্কুলে শুধুমাত্র একটি ছেলেকেই সমঝে চলত তারা, জর্জিনহো। যদিও জর্জির সঙ্গে এদের কোনোদিন সেভাবে কথাকাটাকাটিও হয়নি। কিন্তু জর্জি নিজেও একে ভাঁজ পরিবারের ছেলে, তার ওপর প্রেত যত শয়তানই হোক না কেন, ওঝাকে সে সমঝেই চলে সচরাচর। জর্জির ভাই বলেই লিওর ওপরেও এরা কখনো তেমন চড়াও হয়নি। লিওনার্দোও জর্জির পরামর্শ মতন এদের ত্রিসীমানায় থাকত না।
কাণ্ডটা ঘটে ক্রিসমাসের ছুটি শুরু হওয়ায় আগের দিন।
স্বাভাবিক ভাবেই স্কুল সেদিন প্রায় ফাঁকাই ছিল। একজন শিক্ষক, একজন অশিক্ষক কর্মচারী, দুজন অভিভাবক আর গুটিকয় ছাত্র ছাড়া কেউই ছিল না। জর্জি স্কুলে গেছিল। ধর্মতত্ত্ব আর জ্যোতির্বিদ্যার ওপর লাইব্রেরি থেকে দুএকটা বই আনতে। লিওনার্দোও যথারীতি দাদার সঙ্গী হয়। লিও স্কুলচত্বরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল আপনমনে। এমন সময়ে স্কুলের একদম পেছনের কোনার দিকে ক্লাসরুমটা থেকে একটা গোঙানির আওয়াজ শুনে নেহাত কৌতূহলবশতই সেদিকে এগিয়ে যায় সে। ক্লাসরুমটার দরজা বন্ধ দেখে। এবং গোঙানির আওয়াজটা বাড়ছে শুনে একেবারে পেছনের দিকে জানালায় উপস্থিত হয় লিও, প্রায় টিকটিকির মতন দেওয়াল বেয়ে বেয়ে।
জানালাটা সামান্য ফাঁক করে যে দৃশ্য দেখে লিও, সে এখনও মাঝেমাঝে তার। দুঃস্বপ্নে হানা দেয়। দেখে যে ওরই প্রিয় বন্ধু ভিসিয়েন্তেকে মাটিতে উপুড় করে পেড়ে ফেলেছে সেই মূর্তিমান তিন শয়তান। ভিসিয়েন্তের নিম্নাঙ্গের বস্ত্রটি ঘরের এককোণে লুটোচ্ছে, তার দুই হাত ধরে আছে সেই তিন শয়তানের একজন, আরেকজন। ভিসিয়েন্তের চুলের মুঠি ধরে মুখে কিছু একটা গুঁজে দেওয়ার চেষ্টারত।
আর তৃতীয়জন? তারও নিম্নাঙ্গের বস্ত্র নেই, সে ভিসিয়েন্তের উলঙ্গ পশ্চাদ্দেশের। ওপর ঝুঁকে বসে সেখানে কিছু একটা সজোরে প্রবিষ্ট করার চেষ্টা করছে!