মুম্বাইয়ের কথা অনেক শুনেছেন মার্টিনেজ, যে কোনো পোর্তুগীজ শিশুকেই তাদের ইতিহাসের কথা, প্রাক্তন সাম্রাজ্যের কথা পড়তেই হয়। এককালে পূর্বে পোর্তুগীজ উপনিবেশের পত্তনের সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল এই শহর। ব্রিটিশদের সঙ্গে দু একবার যুদ্ধও হয় পোর্তুগীজদের, এই বন্দরনগরীর দখল নিয়ে। শেষে ষোলশ একষট্টি নাগাদ ব্রিটেনের রাজা দ্বিতীয় চার্লসের সঙ্গে পোর্তুগালের রাজকুমারী ক্যাথারিন ডি ব্র্যাগাঞ্জার বিয়ে হলে সেই বিয়ের যৌতুকস্বরূপ মুম্বাইনগরী ব্রিটিশদের উপহার দেওয়া হয়।
সামান্য হাসলেন মার্টিনেজ, এখন না হয় নাম হয়েছে মুম্বাই, এই শহরের পুরনো। নাম বম্বে, সেও পোর্তুগীজদেরই দেওয়া।বম-বেইম, নিজের মনেই আওড়ালেন তিনি, পোর্তুগীজে এর অর্থ ভালো উপসাগর।
ভালো হোক, সবার ভালো হোক এই শহরে। ভালো কিছু করার জন্যেই তো । এসেছেন মার্টিনেজ এখানে। ভালো হোক তিয়াগোরও।
তিয়াগোর কথা মনে আসতেই বুকের বাঁদিকটা চিনচিন করে উঠল মার্টিনেজের।
বেঁচে আছে সে। এখনও। যদিও না বেঁচে থাকার মতোই। কোমাতে লোকজন বছরের পর বছর বেঁচে থাকতে পারে, মার্টিনেজকে তাই বলেছেন ডাক্তার সে বেঁচে থাকবে ভেজিটেটিভ স্টেটে! ভেজিটেটিভ স্টেট, কথাটা মনে পড়তেই রাগ, অসহায়তা আর ক্ষোভ মিলে যেন বুকটা মুচড়ে দিল তার।তার সাগরছোঁচা ধন, সাতরাজার ধন এক মানিক, চোখের মণি তিয়াগো নিঃসাড় জীবন্ত হয়ে বেঁচে থাকবে তার সামনে? তিনি বাবা হয়ে অসহায়ের মতন দেখবেন? চলে ফিরে বেড়াবেন, আনন্দ করবেন, হাসবেন, খাবেন, ঘুরবেন? হয় না। এ কিছুতেই হয় না। ডাক্তাররা যা করার করুক, নিজে একটা চেষ্টা করবেনই মার্টিনেজ, দরকার হলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও। যা হয় হোক, নিজের ছেলেকে ওই অবস্থায় কিছুতেই দেখতে পারবেন না মার্টিনেজ, কিছুতেই না।
মরতে হলে মরবেন, কিন্তু শেষ চেষ্টাটুকু করা ছাড়বেন না। তাতে অন্তত ওপারে গিয়ে সিসিলিয়ার সামনে দাঁড়াতে পারবেন, ক্ষমা ভিক্ষা করার জায়গাটুকু অন্তত তার থাকবে। বলতে পারবেন যে হ্যাঁ, শেষ চেষ্টা তিনি করেছিলেন, নিজের সবটুকু দিয়েই করেছিলেন।
ফার্নান্দোর কাছে যদিও তিয়াগোর এতদিন বেঁচে থাকাটা শুভ সংকেত বলেই মনে হয়েছে, সে হোক না জীবন্বত অবস্থাতেই। আজ অবধি কেউ এতদিন বাঁচেনি মার্ট, এয়ারপোর্টে মার্টিনেজকে ছাড়তে এসে কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন তিনি। যখনই। মৃত্যু নেমে এসেছে আমাদের ওপর, এসেছে কেউটের ছোবলের মত, বাজপাখির ছোঁয়ের মতন। কাউকে মুহূর্তকাল সময় দেয়নি সে। সেখানে তিয়াগোর এতদিন বেঁচে থাকাটা খুবই ভালো কিছু ঈঙ্গিত দিচ্ছে। আমার মন বলছে তুমিই সেই লোক মার্ট, যার কথা লিওনার্দোর ডিক্লারেশনে আছে। ভাঁজ ফ্যামিলিকে তুমিই হয়তো রক্ষা করবে মার্টি। বলে চুপ করে ছিলেন ফার্নান্দো। মার্টিনেজ জানেন কেন। সত্যিই যদি মার্টিনেজ সেই চিহ্নিত লোকটি হন, তবে এই হয়তো ফার্নান্দোর সঙ্গে মার্টিনেজের শেষ দেখা।
লিওনার্দোর ডিক্লারেশনে এমন একজনের উল্লেখ আছে যিনি অসমসাহসী, বীর যোদ্ধা এবং নিজ কর্মফল হেতু বিপুল পুণ্যের অধিকারী। তিনিই নাকি কোনো এক প্রাচ্যদেশীয় মহাপুরুষের সহায়তায় সেই অত্যন্ত দুরূহ কাজটি সমাপন করবেন, ভাঁজ পরিবারকে সেই মহাশাপ থেকে উদ্ধার করবেন। সময়টাও প্রায় হুবহু মিলে যাচ্ছে।
কিন্তু তার বিনিময়ে সেই ভাঁজ বংশাবতংসকে উৎসর্গ করতে হবে নিজের প্রাণ!
হালকা চালেই জিজ্ঞেস করেছিলেন মার্টিনেজ, কিন্তু পাপাই, আমার তো তেমন কোনো ভালো কর্মফল নেই। এমন কোনো পুণ্যকাজ করেছি বলে তো মনে পড়ে না। আমার।
সে কি মার্ট? লোকের কোনো পুণ্য করোনি তুমি আজ অবধি?তাই বলতে চাও? এই যে এখানে আসার আগে অতগুলো শিশুর প্রাণ বাঁচিয়ে এলে তুমি, তার মতন পুণ্য কিছু আছে? খুন করলে ঈশ্বরের দরবারে তার শাস্তি আছে, আর অতগুলো প্রাণ বাঁচালে তার পুণ্যফল বলে কিছু থাকে না?
জবাব ছিল না মার্টিনেজের কাছে।
কিছুক্ষণ পর যখন চোখ তুললেন ফার্নান্দো, তখন তার দুচোখ জলে ভেজা, ধরা গলায় বললেন, আর যদি সেই বেতালের মুখোমুখি হওয়ার দুর্ভাগ্য তোমার হয় মার্ট, তবে তাকে প্রশ্ন করতে ভুলো না, এত মৃত্যু, এত কষ্ট, এত প্রায়শ্চিত্তের পরেও কি আমাদের দুর্ভোগ শেষ হয়নি? কতদিন থাকে পূর্বপুরুষের পাপের উত্তরাধিকার? কেন বইতে হবে আমাদের এই অভিশাপের জের? আমি চাই তুমি কাজ শেষ করে সুস্থ সবলভাবে ফিরে এস মার্ট। আর যদি ফিরে নাও আসো, আমার কোনো দুঃখ থাকবে না। আমি জানব আমার ছেলে মহৎ কাজের জন্যে আত্মবলিদান দিয়েছে। আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ মার্ট। অ্যান্ড রিমেম্বার, আই লাভ ইউ।
.
১৭৫৫। সেপ্টেম্বর। স্বিনভান লেক, হোলার, আইসল্যান্ড।
নিস্তরঙ্গ হদের জলে বৈঠার ছপছপ আওয়াজ ছাড়া আর বিশেষ কোনো আওয়াজ নেই। এই বিশ্বচরাচরে। শুধু মাঝেমধ্যে মাথার ওপর উড়ে যাওয়া পাখিদের কর্কশ আওয়াজ ছাড়া। সন্ধে হয়ে এল, ওরা বাসায় ফিরছে।
প্রায় হ্রদের মাঝামাঝি চলে এসেছেন দুজনে, সন্ধে নেমে এসেছে অনেকটাই। ওপারের চার্চের প্রায় পুরোটাই দেখা যাচ্ছে এখন। মাথার উপর তারাভরা বিশাল আকাশ, আর তার সামনে নিচ্ছিদ্র নিরঙ্কু জমাট অন্ধকার পাহাড়ের মতোই দিগন্তের অনেকটা আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে সেই চার্চ।