হবেই, মনে মনে ভাবলেন জর্জিনহো। উত্তর গোলার্ধে হলে কী হবে, জায়গাটা দরকারের থেকে অনেক বেশিই উত্তরঘেঁষা। আর তার ওপর এখন তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। এক হ্রদের ধারে। হ্রদের হিমশীতল জল ছুঁয়ে আসা বাতাস তার যাবতীয় পোশাকের স্তর ভেদ করে তার অন্তরাত্মাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল।
দেশটার নামই আইসল্যান্ড; আক্ষরিক অর্থেই বরফের দেশ, হিমতুষারের রাজ্য। এখানকার আকাশের বুকে খেলে বেড়ায় বিচিত্র সব আলোর ভুলভুলাইয়া ম্যাজিক, লোকে তার নাম দিয়েছে অরোরা বরিয়ালিস। তার ওপর জায়গাটা আইসল্যান্ডেরও আরও উত্তরে, উত্তরমেরুর আরও কাছে। মে থেকে অগাস্টের মাঝামাঝি অবধি এখানে সূর্য অস্ত যায় না। জর্জি অনেক ভেবেচিন্তেই সেপ্টেম্বর মাসটা বেছে নিয়েছে। এসব কাজ অন্ধকার ছাড়া হয় না, অগাস্ট অবধি এই এলাকা আলোয় আলোকময়। তার ওপর সবে গ্রীষ্মঋতু শেষ হয়েছে, ফলে হ্রদে এখনও জল আছে; এই সেপ্টেম্বর মাসে এখনও নাব্য সেই হ্রদ, কিন্তু শীতের তীক্ষ্ণ নখরের তীব্রতা আরও বেড়ে উঠেছে সেই জল ছুঁয়ে আসা হাওয়ার কামড়ের থেকে।
জর্জিনহোর পিছনে ছিল লিওনার্দো। এই প্রবল ঠান্ডায় লিওনার্দোর দাঁতে দাঁত লেগে যাওয়ার শব্দ শুনে সামান্য কৌতুক বোধ করছিলেন জর্জিনহো।ভাইটা আর মানুষ। হল না! নেহাত দাদার তন্ত্রমন্ত্রের শক্তির ওপর অপার শ্রদ্ধা আছে তাই।নইলে পরিবারের সবার চক্ষুশূল এই কালাপাহাড়ি বড় দাদাটির এত ন্যাওটা হয়ে পড়ত না লিওনার্দো।
দুজনের পরনেই শীতরোধক পোশাক, তবে তাতে শীত খুব একটা আটকাচ্ছে বলে দুজনের কারোরই মনে হচ্ছে না; ওই মন্দের ভালো আর কী। অবশ্য দিনের এই সময়টাও শীতের কামড় শুরু হওয়ার মুখে, প্রায় সন্ধে হওয়ার কাছাকাছি। ক্ষীণ। সূর্যের আলো এখনও রয়ে গেছে আকাশে। গ্রীষ্মের পর ছমাস এই এলাকা ডুবে থাকবে আঁধার রাত্রিতে। সেই আলোআঁধারিতে লেকের অন্যপারে এক প্রাচীন সৌধের অবয়ব দেখা যাচ্ছে। জর্জিনহো জানেন ওটা কী, ওখানে যাওয়ার জন্যেই তার এখানে আসা।
হোলার চার্চ। মানে প্রাচীন হোলার চার্চ, এখন পরিত্যক্ত।নতুন হোলার চার্চশহরের আরও মাঝখানে তৈরি হয়েছে।
এই চার্চটি পরিত্যক্ত কেন হল সেটা জর্জিনহো জানেন, ভালো করেই জানেন। এবং সেই জন্যেই সেদিকে আজকে যেতে চাইছেন তিনি। আর সঙ্গী করেছেন নিজের ভাইকে।
লিওনার্দো। নিজের থেকে প্রায় দশবছরের ছোটো এই দুর্বল ভীরু ভাইটির প্রতি প্রায়। অপত্যস্নেহ বোধ করেন জর্জিনহো। আজ ওকে আনা হয়তো ঠিক হয়নি। আজ হয়তো। ও এমন অনেক কিছু দেখবে যা ওর দেখা উচিত নয়। কিন্তু এছাড়া আর উপায় ছিল।
জর্জিনহোর। আর কাকেই বা নিজের থেকে বেশি ভরসা করতে পারেন জর্জিনহো? এই দুনিয়ায় সেই জিপসি রমণী ছাড়া আর কাকেই বা এত ভালোবেসেছেন তিনি?
আর এ ছাড়া আরও একটি কারণ আছে।
একদম ভেতরের জামার বুকপকেটে কতগুলো কাগজ এখনও সযত্নে রাখা আছে। জর্জিনহোর। তারই নিজের হাতে লেখা কতগুলো পাতা। কপি করা, বহু কষ্টে খুঁজে পাওয়া তারই এক পূর্বপুরুষের লেখা ডায়েরির কিছু পৃষ্ঠা থেকে কপি করা কয়েকটা পা। সেগুলো একবার ছুঁয়ে মনটা স্থির করলেন তিনি। তারপর আড়চোখে একবার লিওনার্দোর দিকে তাকালেন জর্জিনহো। যদি তাই হয়, ডায়েরিতে যা লেখা আছে যদি তাইই সত্যি হয়, তবে লিওনার্দোকে দেখেই মরতে চান জর্জিনহো। পৃথিবীতে আর কারও ওপর অত টান নেই তার।
তা ছাড়া সেই জিপসি রমণী বলে দিয়েছিল না জীবনের শ্রেষ্ঠ কর্তব্য পালন করতে যাওয়ার দিনে নিজের ছায়াকে সঙ্গে রাখতে৷ লিও ছাড়া আর কেই বা আছে যে তাকে ছায়ার মতন অনুসরণ করে?
ছোট্ট নৌকাটা লেকের পাশেই একটা ঝোঁপের মধ্যে লুকোনো ছিল। দুইজনে টেনে বার করলেন সেটা, তারপর জলে ভাসিয়ে চেপে বসলেন। তারপর দুইজনেই বৈঠা ফেললেন জলের বুকে। সামনে জর্জিনহো ভাজ, পেছনে লিওনার্দো ভাজ।
.
২০১৬। ছয় অক্টোবর, পঞ্চমী, শুক্রবার। মুম্বাই
মুম্বাইতে নেমেই যেটা সবচেয়ে বিরক্তিকর লাগল মার্টিনেজের, সেটা হচ্ছে গরম আর আদ্রর্তা। এই অক্টোবর মাসেও উত্তর গোলার্ধের কোনো শহরে যে এত গরম আর বাতাসে এত জলীয়বাষ্প থাকতে পারে, ভাবতেই পারেননি মার্টিনেজ। যদিও তিনি অনেক আগেই শুনেছেন মুম্বাইয়ের কুখ্যাত ভিড় আর গরমের কথা; তবে শোনা কথা এক, আর তাকে প্রত্যক্ষ করা আরেক। ভুরু কুঁচকে একবার ভারতবর্ষের প্রখর সূর্যের দিকে তাকালেন তিনি, তারপর অ্যাভিয়েটর সানগ্লাসটা পরে নিলেন।
এয়ারপোর্টের লাউঞ্জ ছাড়িয়ে একটু বাইরে আসতেই দেখলেন প্ল্যাকার্ড হাতে কিছু লোকজন দাঁড়িয়ে, তারই মধ্যে এক খর্বকায় ভারতীয়ের হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডে লেখা,
মিস্টার মার্টিনেজ ভাজ। ওয়েলকাম টু ইন্ডিয়া। নীচে পোর্তুগাল কনস্যুলেটের নাম।
যাক অকারণ অপেক্ষা করতে হল না; স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন মার্টিনেজ। ভারতীয় লোকটি দৌড়ে এসে মার্টিনেজের লাগেজ নিয়ে নিল। আগে এসবে অস্বস্তি হত মার্টিনেজের, পরে বুঝেছেন এই উপমহাদেশে বা তার আশেপাশের অঞ্চলে এটাই শিষ্টাচার। তার পেছন পেছন পার্কিং-এ এলেন তিনি। তারপর লোকটি একটি কালো। রঙের মার্সিডিজের বুটস্পেসে লাগেজ রেখে পেছনের দরজা খুলে সামান্য ঝুঁকে দাঁড়াল, অর্থাৎ, সাহেব পদার্পণ করুন! মার্টিনেজ ভেতরে আরাম করে বসতেই লোকটি চট করে ড্রাইভারের সিটে বসে স্টিয়ারিং-এ হাত দিল।