তারপর যেটা লিখেছেন মিগুয়েল সেটাই সবচেয়ে আশ্চর্যের। শয়তানের সঙ্গে ঠিক কী কথা হয়েছে তার বিস্তারিত বিবরণ তিনি দেননি। তার বদলে যেটা উনি লিখেছেন… দাঁড়াও তোমাকে পড়াচ্ছি।
এই বলে উঠে যান ফার্নান্দো। বারান্দায় চুপ করে বসে থাকেন মার্টিনেজ।
এই তো কয়েকদিনের কথা। সেদিনই তো জন্মাল ছেলেটা। সারা বাড়িতে আনন্দের। হুল্লোড় খেলে গেছিল।কমান্ডান্ট নিজে এসেছিলেন ছেলেকে দেখতে, স্বরাষ্ট্রসচিব স্বয়ং অভিনন্দন বার্তা পাঠান। আর সিসিলিয়া, আহা এখনও চোখ বন্ধ করলেই তার মুখের। ঔজ্জ্বল্য দেখতে পান মার্টিনেজ।
বুকের মধ্যে একটা প্রায় ভুলে যাওয়া ব্যথা তিরের মতই এসে বিঁধল মার্টিনেজের বুকে। সিসিলিয়া মারা যাওয়ার পর দিশেহারা হয়ে গেছিলেন মার্টিনেজ। ভেবেছিলেন চাকরি ছেড়ে দেবেন। হাজার হোক জীবনধারনের জন্যে ভাঁজ পরিবারের কোনো ছেলেকে কোনোদিন ভাবতে হয়নি। কিন্তু চাকরি তাঁকে ছাড়েনি, কোনো মূল্যেই এমন সুদক্ষ কম্যান্ডোকে ছাড়তে সেনাবাহিনী রাজি ছিল না।
সিসিলিয়াকে হারাবার দুঃখ ভুলতে মার্টিনেজ তিয়াগোকে আরও বেশি করে জড়িয়ে ধরেন, আর শিশু তিয়াগো মার্টিনেজকে।
বুক ফেটে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল মার্টিনেজের। আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন খানিকক্ষণ।তারপর হু হু করে কেঁদে ফেললেন কম্যান্ডো সার্কেলে ইওরোপের ইস্পাত বলে খ্যাত মার্টিনেজ ভাজ।
পেছনে পায়ের শব্দ পেয়ে দ্রুত চোখ মুছে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলেন তিনি। পরক্ষণেই সামনের চেয়ারে এসে বসলেন ফার্নান্দো। ফার্নান্দো নিজেও খুব উত্তেজিত ছিলেন, না হলে একটু চেষ্টা করলেই হয়তো ছেলের চোখের জল দেখতে পেতেন।
কে জানে, হয়তো দেখতে পেয়েছিলেন, দেখেও দেখেননি।নিজের সন্তানের চোখে জল কেই-বা দেখতে চায়?
একটি প্রাচীন ঝুরঝুরে বই নিয়ে এসে বসলেন ফার্নান্দো। তারপর অতি সন্তপর্ণে কয়েকটা পাতা খুললেন। গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, শোনো, কী লিখছেন মিগুয়েল।
শয়তান অট্টহাস্য করিয়া বলিলেন, পাপিষ্ঠ! যাহা করিয়াছিস ইহা অতি উত্তম। ভোগ, লালসা, হিংসা এসবই আমার বড় প্রিয়, বড়ই ঈপ্সিত। তবুও কেন প্রায়শ্চিত্তের অগ্নিতে জ্বলিতেছিস? শোন মূঢ়, মৃত্যুর ওপর কাহারও অধিকার নাই, আমারও নাই, তোর পূজ্য ঈশ্বরেরও নাই। তবুও কেন উত্তরাধিকারীদের জীবনাকাঙ্খ হেতু এমত বিচলিত হইতেছিস? তুই মূর্খ, তবুও তোর আরাধনা আমার সবিশেষ প্রীতিবর্ধন করিয়াছে, তাই তোর বাঞ্ছা পূরণ করিবার নিমিত্ত আবির্ভূত হইয়াছি। শোন রে মন্দবুদ্ধি, যাহাকে তুই সপরিবারে হত্যা করিয়াছিস, তিনি তোর ঈশ্বরের বিশেষ অনুগ্রহপ্রাপ্ত ছিলেন। তুই তোরই ঈশ্বরের প্রীত্যর্থে তাহারই সেবককে হত্যা করিয়াছিস। মূর্তিভেদে কি ঈশ্বরভেদ হয় রে পাপমতি? তোদের ক্রুশও কি একটি মূর্তি নহে?
এখন শোন, যে অভিশাপের কৃষ্ণচ্ছায়া তোর ও তার পরিবারের ওপর উদ্যত হইয়াছে, উহা হইতে পরিত্রাণের কোনোই উপায় নাই। নিজ সন্তানের প্রতি অসীম স্নেহসঞ্জাত ক্রোধ হইতে সেই গাঢ়কৃষ্ণ অভিশাপের উৎপত্তি। আরেক পিতার নিজ সন্তানের প্রতি অসীম স্নেহসঞ্জাত সাহস ও আত্মবলিদান হইতেই একমাত্র ইহার নিবৃত্তি হইলেও হইতে পারে। কিন্তু উহা সহজ নহে, সেই শাপমোচনের পথ অতি দুরূহ, শাণিত ক্ষুরের ধারের ন্যায় দুরতিক্রম্য ও দুর্গম।
শোন রে হীনমতি, এই শাপমোচন অত সহজ নহে। পাপের পূজায় বলিদান আবশ্যক, এই কর্মে তোর বংশধরদের অন্তত আরও তিনজনকে আত্মোৎসর্গ করিতে হইবে। শুধু আত্মোৎসর্গ নহে, জাগাইতে হইবে মৃতদের জগৎ; মহাক্রোধী দেবতাকে পূজার্চনার দ্বারা প্রসন্ন করিতে হইবে, অলৌকিক দ্বারা অসম্ভবকে সম্ভব করিতে হইবে। উত্তরের হিমাঞ্চলাবৃত দেশের এক প্রাচীন সৌধের মৃত্তিকাগর্ভে এক লোহিত চর্মাবৃত মহাযোগী শেষশয়ানে সমাহিত আছেন। আজ হইতে প্রায় দুইশত বৎসর পর তোর পরিবারে এক অতিসাহসী তন্ত্রসিদ্ধ পুরুষ জন্মগ্রহণ করিবে। তোর সেই উত্তরপুরুষ অসামান্য মন্ত্রসাধন দ্বারা সেই ক্রুরশ্রেষ্ঠ মহাযোগীকে মৃত্যুর অপর পার হইতে আহ্বান করিয়া আনিতে সমর্থ হইবে। সেই মহাযোগী পথ নির্দেশ করিয়া দিবেন এবং তদন্তে সেই মন্ত্রসিদ্ধ পুরুষের প্রাণহরণ করিবেন।
আজ হইতে আনুমানিক অর্ধসহস্র বৎসর পর এই অভিশাপ প্রত্যাহৃত হইবে। তৎকালে মৃত্যুর সম্রাট তোর পরিবার হইতে শেষ শিকারটি সংগ্রহ করিয়া ঊর্ধ্বে নক্ষত্রলোকে প্রত্যাগমন করিবেন। সেইদিন তোর পাপের অন্তিম নিবৃত্তি হইবে।
আমি ভীত হইয়া করজোড়ে বলিলাম, প্রভো, তিনটি আত্মোৎসর্গের উল্লেখ করিলেন, একবার উত্তরের হিমাঞ্চলাবৃত দেশে, আর বার অভিশাপ খণ্ডনকালে। কে সেই হতভাগ্য তৃতীয়জন?
মহামহিম শয়তান যেন সহসা সহস্রাক্ষ হইয়া, তাহার সমস্ত ভীতিপ্রদ অগ্নিভ রূপ লইয়া ক্রুর হাসিয়া উঠিলেন।
বলিলেন, কেন, তুই!
.
১৭৫৫। সেপ্টেম্বর। স্বিনভান লেকের তীর, হোলার, আইসল্যান্ড।
সেপ্টেম্বর মাসের হিমশীতল সন্ধে। সমগ্র উত্তর গোলার্ধ যখন শীতের চাদর গায়ে টেনে। নিচ্ছে, তখন পৃথিবীর এই প্রান্তে শীত যে শুধু জাঁকিয়ে বসেই আছে তাই নয়, তার। কামড় মাংস ভেদ করে হাড়ে রীতিমতো কাপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে।