এইখানে ফের থামলেন ফার্নান্দো। তারপর খানিকটা ইতস্তত করে বললেন, জানি। তুমি এসবে বিশ্বাস কর না, তবুও বলি, গ্রিমোয়ার শব্দটা শুনেছো মার্ট?
শব্দটা অবশ্যই শুনেছেন মার্টিনেজ। গ্রিমোয়ার মানে ব্ল্যাক আর্ট বা ব্ল্যাক ম্যাজিক। সম্পর্কিত বই।বিভিন্ন তন্ত্রমন্ত্র, তাবিজকবচ, শত্রুর ওপর অভিশাপবর্ষণ, কারও আত্মাকে। ডাকা, এসব সংক্রান্ত বই। এসব বইয়ে লেখা মন্ত্র উচ্চারণ করে নাকি দেবদূত, পরী, অপদেবতা বা স্বয়ং শয়তানকে ডেকে এনে বা নিজের অনুগত করে কার্যসিদ্ধি করা। যেত। চার্চের চোখ এড়িয়ে এই ধরনের বই চিরকালই পাওয়া যেত। আর গুটেনবার্গ। ছাপার যন্ত্র বানাবার পর তো এই ধরনের বইতে ইওরোপ ছেয়ে গেছিল। তারপর যা। হয়, ধর্মান্ধ জনগণের একাংশ চার্চের বারণ সত্বেও নির্জনে বা একান্তে এইসব প্র্যাকটিস করতে শুরু করে।এইসব বিষয়ে অনেক অবিশ্বাস্য কাহিনি এখনও ইওরোপের পুরোনো। পাবগুলোতে কান পাতলে শোনা যায়।
মার্টিনেজ যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণেই এসবে বিশ্বাস করেন না। কিন্তু আজ সেসব নিয়ে তর্ক করার দিন নয়। তিনি নির্নিমেষ চোখে তার বাবার দিকে চেয়ে রইলেন।
আজ অবধি আমরা যেসব গ্রিমোয়ারের খোঁজ পেয়েছি, তার প্রায় বেশিরভাগই জাল। সবই সে যুগের অনামী কোনো না কোনো লেখকের উদগ্র কল্পনার ফসল। যদিও সেসব কল্পনার তারিফ করতে হয়, কিন্তু দিনের শেষে সেসবই জাল গ্রিমোয়ার। আসল গ্রিমোয়ার বেশিরভাগই চার্চের কড়া তত্ত্বাবধানে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মিগুয়েলের সময় এইসব বিভিন্ন যাদুমন্ত্রের বইতে ছেয়ে গেছিল ইওরোপের প্রতিটি শহর। বিবেকের দংশনে মিগুয়েল তখন জর্জরিত। প্রায়শ্চিত্তের জ্বালায় ছটফট করা আর নিজের বংশধারাকে অভিশাপের হাত থেকে বাঁচাতে বদ্ধপরিকর সেই বৃদ্ধ এই অভিশাপ থেকে বাঁচতে বিভিন্ন গ্রিমোয়ারের শরণাপন্ন হলেন।
এইখানে বলে রাখা ভালো যে আজ অবধি যেসব গ্রিমোয়ারের কথা আমরা জানি বা শুনি, তার মধ্যে বেশিরভাগই জাল হলেও সব নয়। অন্তত তার কয়েকটির প্রাচীনত্ব। নিয়ে তো সন্দেহের কোনো কারণই নেই।তার মধ্যে অন্যতম প্রাচীন গ্রিমোয়ারটির নাম। হল, দ্য কি অফ সলোমন, বা ক্ল্যাভিস সলোমনিস।
ততক্ষণে বেশ রাত হয়ে এসেছে। ডিনারের সময় এল প্রায়। নীচে বাগানের কোনো এক কোণ থেকে রটওয়েলারের চাপা গরগর আওয়াজ ভেসে এল, কিছু একটা দেখেছে বোধহয়। আশ্চর্য উজ্জ্বল আকাশ আজকে, ঠান্ডাটা আজকে বোধহয় একটু বেশি। হঠাৎ একটু শিউড়ে উঠলেন মার্টিনেজ, কোনো কারণ ছাড়াই।
দাবি করা হয় যে, এই কি অফ সলোমন নামের গ্রিমোয়াটি মহান রাজা সলোমনের নিজের হাতে লেখা। তিনি পৃথিবীর সর্বকালের জ্ঞানী রাজা বলে খ্যাত, ওয়াইজ অফ দ্য ওয়াইজেস্ট। সলোমনের লেখা হোক না হোক, বইটি প্রাচীন হিব্রু এবং তৎকালীন মধ্যপ্রাচ্যের আরব উপজাতিদের প্রাচীনতম তন্ত্রমন্ত্র দিয়ে পরিপূর্ণ। বলা হয় যে এই বইয়ে উল্লিখিত কালাজাদু প্র্যাকটিস করতে পারলে স্বয়ং শয়তানকে বশ করা যায়, তাকে দিয়ে যা খুশি করিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু হ্যাঁ, তার আগে নিজের সমস্ত কৃত পাপ। স্বীকার করে শুদ্ধ হতে হবে।
কিন্তু যতটা সহজ ভাবা গেছিল, কাজটা ততটা সহজ নয়। বাজার ছেয়ে আছে। জালি বইতে। শেষে মিগুয়েল খোঁজ পেলেন যে সিরিয়াতে এক আর্চবিশপের কাছে। আসল বইটি আছে। এই আর্চবিশপের বাবা ছিলেন একজন শখের অভিযাত্রী, বিভিন্ন পুরাতাত্ত্বিক জিনিস খুঁজে বার করতে তার বিপুল উৎসাহ ছিল। অনেকদিনের পরিশ্রমের পর তিনিই প্রথম খোঁজ পান বইটির এবং সেইটিই বহু রৌপ্যমুদ্রা ব্যয়ে মিগুয়েল হস্তগত করেন। আর্চবিশপের ছেলে অবশ্য অনেক পরে তার একটি সংস্করণ বাইরে প্রকাশ। করে, অবশ্যই আসল মন্ত্রগুলো বাদ দিয়ে। সেটাকেই আজ লোকে ক্ল্যাভিস সলোমনিস বলে চেনে।
যাই হোক। পনেরোশো নব্বই সালের এক শনিবার, অমাবস্যার রাত। লিসবনের উপকণ্ঠে এক পরিত্যক্ত চার্চ সংলগ্ন প্রাচীন গোরস্থানে মিগুয়েল সেই ক্ল্যাভিস সলোমনিস নিয়ে শয়তানের সাধনায় ব্রতী হলেন। বইয়ের নির্দেশ অনুযায়ী যাবতীয় কর্তব্যকর্ম করে শেষ মন্ত্রটির উচ্চারণ করা মাত্র তিনি শয়তানের দর্শন পেলেন।
হো… হোয়াট? নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারলেন না মার্টিনেজ। গোঁড়া ও প্রাকিটিসিং না হলেও ধর্মে খ্রিস্টান তিনি। শয়তানের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা তিনি দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। আর ইউ সিরিয়াস পাপাই? মিগুয়েলের সামনে শয়তান এসেছিল? স্যাটান হিমসেল্ফ?
মাথা নাড়লেন ফার্নান্দো, নিজের ডায়েরিতে যা লিখে গেছেন মিগুয়েল, হুবহু তাই বলছি মার্ট। আমারও প্রথমে তোমার মতোই কথাটা বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু শয়তানের আগমন থেকে শুরু করে তারপর তার সঙ্গে মিগুয়েলের যে কথোপকথন হয়, তা লিখে। রাখা আছে।মিগুয়েলের ডায়ারির বিবরণ মতো শেষ মন্ত্রটির উচ্চারণ মাত্র উল্কাপাতের মতই একটি আগুনে গোলামিগুয়েলের সামনে এসে সশব্দে আছড়ে পড়ে এবং মিগুয়েল ছিটকে পড়ে যান। তারপর উঠে দেখেন যে তার সামনে একটা আগুনের পিণ্ড মানুষের আকার নিয়ে দাঁড়িয়ে, সেই শয়তান।
তারপর? আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন মার্টিনেজ।