সে যাই হোক, এই করতে করতে শেষতক বছর পাঁচেক আগে আমাদেরই পারিবারিক লাইব্রেরিতে দেওয়ালের মধ্যে গাঁথা একটি গুপ্ত দেরাজ থেকে মিগুয়েলের ডায়েরি উদ্ধার করি।
সেই ডায়েরিতে অনেক কথা লেখা আছে। সব তোমাকে বলার দরকার নেই। মিগুয়েল দেশে ফিরে শোনেন তার বড় ছেলের দৈব দুর্বিপাকে মারা যাওয়ার খবর। ছেলের শোকে মিগুয়েলের স্ত্রী আত্মহত্যা করেন। বড় ছেলের পরেও মিগুয়েলের আরও একটি ছেলে ও মেয়ে ছিল, তাদের তিনি বহু পরিশ্রমে মানুষ করেন। ছেলে মারা যাওয়ার খবর শুনে মিগুয়েলের মনে ভয় ও অনুশোচনা, দুইই ঢোকে। তিনি ভেবেছিলেন যে করেই হোক তিনি ইন্ডিয়া ফিরে গিয়ে যেখানকার জিনিস সেখানে। ফিরিয়ে দিয়ে আসবেন। ফলে পোপের হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা তাকে নাকচ করতে হয়। তার থেকেও বড়ো কথা, বস্তুটি হাতে নিয়ে মিগুয়েলের মনে এক আশ্চর্য অতীন্দ্রিয় অনুভূতির সৃষ্টি হয়। কোনোমতেই তিনি এটা হাতছাড়া করতে চাননি।
মিগুয়েলের সেই বেঁচে থাকা ছেলেটির নাম ছিল আলমাও। আলমাওয়ের দুটি সন্তান হয়, বড়টি মেয়ে, নাম বেথানিয়া। নিজের বিয়ের দিন সম্পূর্ণ অলৌকিক উপায়ে জ্বলে গিয়ে বেথানিয়া মারা যান। এই ঘটনাটা এতই অবিশ্বাস্য, যে তোমাকে না বলে। পারছি না।
ভাজ পরিবারের বড় মেয়ের বিয়ে। রাজপরিবার থেকে শুরু করে সারা দেশের গণ্যমান্যরা উপস্থিত, বিদেশাগত অতিথিও কম নেই। স্বয়ং রাজা বিশেষ আশীর্বাদ পাঠিয়েছেন, উপহার দিয়েছেন বহুমূল্য হীরের নেকলেস। লিসবনের সবচেয়ে পুরোনো। ও বড় ক্যাথিড্রাল সে দে লিসবোয়ার আর্চবিশপ স্বয়ং নিজে বিয়ে দিতে উপস্থিত। দামি গাউন পরে বেথানিয়া চার্চের আইল ধরে হেঁটে এসেছেন এইমাত্র, আর্চবিশপ। মন্ত্রোচ্চারণ করছেন। শপথ নেওয়ার ঠিক সেই স্মরণীয় মুহূর্তে হাসিমুখে বেথানিয়া সলজ্জ ভঙ্গিতে বলবেন, ইয়েস আই ডু, এমন সময় হল ভর্তি লোকের সামনে, সম্পূর্ণ অলৌকিক ভাবে বেথানিয়া সমস্ত কাপড়চোপড় নিয়ে দপ করে জ্বলে ওঠেন। মানে একটুখানি আগুন লেগে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়া নয়, যেখানে দূরদূরান্ত অবধি কোথাও আগুনের চিহ্নমাত্র ছিল না সেখানে পুরো মানুষটাই দপ করে একসঙ্গে জ্বলে ওঠে। যেন তুলোভরা কাগজের পুতুল কেউ আপাদমস্তক পেট্রলে ভিজিয়ে তার ওপর। দেশলাইকাঠি ছুঁড়ে মেরেছে! এই বুদ্ধির অতীত, ব্যাখ্যার অতীত অনৈসর্গিক দৃশ্য দেখে উপস্থিত মহিলারা। আতঙ্কে অজ্ঞান হয়ে যান, আর্চবিশপও তাই। বর বেচারির হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে সেখানেই মারা যায়। বেথানিয়ার মরণপণ আর্তনাদ, জুলন্ত গাউন নিয়ে দৌড়াদৌড়ি, পোড়া মাংসের গন্ধ, বাচ্চাদের কান্নার শব্দে জায়গাটা প্রায় নরক হয়ে ওঠে। সমস্ত অতিথিরা হুড়োহুড়ি করে পালাতে থাকেন, তাতে আবার মন্ত্রীপরিষদের দু একজন সদস্য সামান্য চোটও পান। অত বড় ক্যাথিড্রালের দামি কার্টেনে আগুন লেগে যায়। সামনের সারির কিছু বেঞ্চও পুড়ে যায়, পুড়ে কালো হয়ে যায় পূর্বদিকের দেওয়ালের মিকেলেঞ্জেলোর অনুকরণে আঁকা বিশাল মুরাল।
প্রভাবশালী হওয়ার জন্যে অনেক কষ্ট করে হলেও প্রচুর টাকা ছড়িয়ে ভাঁজ পরিবার। এই ঘটনা ধামাচাপা দেয়। নইলে সে দে লিসবোয়া তো প্রথমে দাবিই তুলেছিল যে ভাঁজ পরিবার শয়তানি কালাজাদু প্র্যাকটিস করে, তারা খ্রিস্টবিরোধী।ভাজ পরিবারকে দেশছাড়া করা হোক।
ধৈর্য হারাচ্ছিলেন মার্টিনেজ। তার কাছে সময় বড় অল্প, তিয়াগো আজ মৃত্যুশয্যায়, এবং তাকে বাঁচানোর জন্যে তিনি নিজের শরীরের শেষ রক্তবিন্দুটুকু অবধি আজ খরচ করতে রাজি। এত সব গালগল্প কি এখন না শুনলেই না? একটু রূঢ়ভাবেই বললেন, পাপাই, সব বুঝলাম, এখন প্লিজ বলবে তিয়াগোকে বাঁচাবার জন্যে ঠিক কী কী করতে হবে?
থমকালেন কি ফার্নান্দো? সন্তানের রূঢ়ভাষ কি কোনোভাবে আঘাত করল তাকে? হয়তো করল, কিন্তু মার্টিনেজের এই উদভ্রান্ত উদ্বেগ বুঝলেন তিনি, হাজার হোক, তিনিও যে বাবা, মার্টিনেজেরই বাবা! রডরিগোর সময়ে তিনি নিজেও কি এমন উদভ্রান্ত, এমন অধৈর্য হননি?
সবই বলছি মার্ট। সব কথা যতটা সম্ভব খুলে না বললে তোমার পক্ষে হয়তো। পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া অসুবিধা হয়ে যাবে।এরপর যা বলব তার প্রতিটি শব্দ শুনবে, মন দিয়ে শুনবে, ওকে? নাউ লিসন…
তখন রাত প্রায় সাড়ে আটটা, দেওয়ালে খেলতে থাকা দুটি ছায়া আরও নিবিড় হয়ে ঝুঁকে বসল পরস্পরের দিকে। জুলাই মাসের আশ্চর্যরকম পরিষ্কার আকাশ। বৃশ্চিকরাশি স্পষ্টতই যেন চোখ মেলে তাকাল এই পিতাপুত্রের দিকে, জ্যেষ্ঠা নক্ষত্র তার সবটুকু আলো ঢেলে দিতে চাইল সেই গোলটেবিলটি ঘিরে। পাঁচশো বছর ধরে আবর্তিত এক বিশেষ নক্ষত্রমণ্ডলের চলন ধীর হয়ে আসতে লাগল।
আগেই বলেছি বেথানিয়ার ঘটনা ঘটার সময় মিগুয়েল যথেষ্ট বৃদ্ধ। অনুতাপের আগুনে পুড়তে পুড়তে তিনি ভাবলেন যে এটা তিনি যেখান থেকে এনেছিলেন। সেখানেই ফিরিয়ে দিয়ে আসবেন।কিন্তু তখনই তার যথেষ্ট বয়েস হয়েছে, তিনি বুঝতে পারছিলেন যে আরেকটা লম্বা সমুদ্রযাত্রার ধকল তার শরীর আর নিতে পারবে না। তাছাড়া ফেরত কাকে দেবেন? কীভাবে দেবেন? এসব প্রশ্নও তাকে বিচলিত করছিল খুবই। আর তার থেকেও উদগ্র হয়ে উঠছিল তার জিজ্ঞাসা, জিনিসটা আসলে কী? এমন কী জিনিস যার জন্যে খ্রিস্টধর্মের সর্বোচ্চ পদাধিকারী এত উতলা? কী সেই জিনিস যার জন্যে তার পরিবারের ওপর নেমে এসেছে এই চরম অভিশাপ?