বাবার কথা মতন তাই করলেন মার্টিনেজ, প্রথমে কিছু বুঝলেন না। তারপর মে সয়ে আসতে ব্যাপারটা উনি ঠাহর করতে পারলেন।
প্রায় আসল কংক শেলের মতই এই বস্তুটিরও একটি স্পাইরাল আছে। এর যে লাল রঙের সূক্ষ্ম বিদ্যুৎপ্রভা উনি দেখছিলেন আগে, সেগুলো যেন খেলে যাচ্ছে স্পাইরালের ভাঁজ বরাবর।
সামান্য বিচলিত মুখ তোলেন উনি, ইয়েস পাপাই,আই ক্যান সি দ্য স্পাইরাল।
এই বলে জিনিসটা আইভরি বাক্সে রেখে, বাক্সটা বন্ধ করলেন মার্টিনেজ। তারপর সেটা বাবার দিকে ঠেলে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ পাপাই, কী যেন বলছিলে?
ততক্ষণে তাদের সামনে উৎকৃষ্ট কফি এনে হাজির করেছে পরিচারক। তাতে একটা চুমুক দিয়ে শুরু করলেন ফার্নান্দো, মিগুয়েল তখন দেশে ফিরে এসেছেন, তখন পোপ চতুর্থ পায়াস। ইনি একটু গুছিয়ে বসেই গোপন এত্তেলা পাঠান মিগুয়েলের কাছে, জিনিসটা তার হাতে তুলে দেওয়ার জন্যে।– কিন্তু পোপ যেটা অসম্ভব ভেবেছিলেন, তাই হল। মিগুয়েল প্রথমে পোপের আদেশ এড়িয়ে গেলেন কয়েকবার। শেষে আরও চাপ বাড়লে মিগুয়েল এটি পোপের হাতে তুলে দিতে সরাসরি অস্বীকার করেন।
স্বাভাবিক ভাবেই পোপ চতুর্থ পায়াস এবার পর্তুগাল সম্রাটের দ্বারস্থ হন। পোপের ব্যক্তিগত সচিব পোপের চিঠি নিয়ে স্বয়ং হাজির হন সম্রাটের দরবারে। সালটা ১৫৬৫, তখন পর্তুগালের শাসক বালক সম্রাট প্রথম সেবাস্তিয়ান।
সম্রাট সেবাস্তিয়ানের লাইফটা খুব অদ্ভুত, জানো মার্ট । ইনি তিন বছর বয়সেই রাজা হন এবং নাবালক রাজার রিজেন্সি বা রাজপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্বভার নেন তার ঠাকুমা, অস্ট্রিয়ার বিখ্যাত হ্যাঁন্সবার্গ রাজবংশের মেয়ে রানি ক্যাথরিন।
ক্যাথরিন অত্যন্ত ধর্মভীরু মহিলা ছিলেন, জেসুইটদের কথায় উঠতেন ও বসতেন। পোপ নিশ্চিন্ত ছিলেন যে রানির আদেশ না মেনে মিগুয়েলের উপায় থাকবে না। কিন্তু দেখা গেল যে মিগুয়েলও কূটনীতিতে কম প্রতিভাধর ছিলেন না। তিনি রানির সঙ্গে গোপন দেখা করে এমন জিনিস উপঢৌকন হিসেবে দিলেন যে পুরো ঘটনার মোড় ঘুরে গেল।
রানি ক্যাথরিন সমগ্র ইওরোপে কালেক্টর সংগ্রাহক হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন। কথিত আছে অন্য অনেক অদ্ভুত জিনিসের সঙ্গে তাঁর সংগ্রহেনাকি একটি ইউনিকনের শিংও ছিল।তার ব্যক্তিগত সংগ্রহই এই সমগ্র পশ্চিম ইওরোপের প্রথম কুটক্যামার।
কী?, কুন্স হোয়াট? শেষ শব্দটা ভালো করে বুঝতে পারলেন না মার্টিনেজ।
কুন্সটক্যামার, শব্দটা জার্মান। ওর মানে হচ্ছে ক্যাবিনেট অব কিউরিওসিটি বা। ক্যাবিনেট অব ওয়ান্ডার। এই ধরনের ব্যক্তিগতকুটক্যামারবাকুন্সটক্যাবিনেট থেকেই পরে মিউজিয়ামের ধারণা আসে। ব্যাখ্যা করেন ফার্নান্দো। একটু দম নিয়ে ফের বলতে থাকেন,
কিন্তু বিশেষ করে যে জিনিসের বিপুল সংগ্রহের জন্যে রানি ক্যাথরিন ইওরোপের নজর কেড়ে নিয়েছিলেন তা হচ্ছে চীন থেকে আনা পোসিলিনের বাসনপত্র এবং অন্যান্য শিল্পদ্রব্য। এ ব্যাপারে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন এবং তার কাছে এই পোর্সেলিনের শিল্পদ্রব্যের সম্ভার পর্তুগালের রাজবৈভবের প্রতীক ছিল। আর। এইখানেই বোঝা গেল মিগুয়েলের বুদ্ধিমত্তা। তুমি নিশ্চয়ই জানো যে এশিয়াতে আমাদের সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল গোয়া। গোয়া ছাড়াও, পনেরোশো সাতান্ন নাগাদ আমরা আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বন্দরশহর দখল করি এশিয়াতে। উনিশশো নিরানব্বই অবধি আমাদের অধিকারে ছিল সে শহর।
ম্যাকাও, বলে ওঠেন মার্টিনেজ। বাণিজ্যবন্দর হংকং এর কাছে ছোট্ট দ্বীপ। ম্যাকাও। ক্যাসিনো ও বিলাসের স্বর্গরাজ্য, বছর দেড়েক আগে সেখানে একবার গেছিলেন বটে মার্টিনেজ।
মৃদু হাসেন ফার্নান্দো, চীনে তখন মিং রাজবংশের শাসন, পোর্সেলিন শিল্পের রমরমার সময়। গোয়া থেকে চলে আসার আগে মিগুয়েল প্রচুর পোর্সেলিনের ভাস আর অন্যান্য জিনিসপত্র ম্যাকাও থেকে আমদানি করেন এবং সেইসব নিয়ে পর্তুগাল চলে আসেন। সেই অসামান্য কারুকার্যখচিত পোর্সেলিনের সম্ভার নিয়ে মিগুয়েল সোজা রানি ক্যাথরিনের কাছে হাজির। আর রানিমাও গলে জল! ফলে যা হওয়ার তাই হল, পোপের সচিবকে খালি হাতেই রোমে ফিরতে হল। রাজদরবারে মিগুয়েলের প্রতিপত্তি বেড়ে দ্বিগুণ হল।
এরপরেও রোমের পক্ষ থেকে অনেক চেষ্টা হয়েছে এই জিনিসটি উদ্ধার করার। অন্য কোনো পরিবার হলে হয়তো এতদিনে জিনিসটা ভ্যাটিকানের গোপন প্রকোষ্ঠে শোভা পেত। কিন্তু পর্তুগালের বুকে দাঁড়িয়ে ভাঁজ পরিবারের হাত থেকে কোনো জিনিস কেড়ে নেওয়া কতটা অসম্ভব সে তুমিই জানো।
একটা খটকা মার্টিনেজের মনে রয়েই গেল, কিন্তু পোপের হাতে তুলে দিতেই বা কি অসুবিধা ছিল? মানে মিগুয়েল হঠাৎ এটা ফেরত দিতে অস্বীকার করলেনই বা কেন? পোপকে দেবেন বলেই তো দখল করেছিলেন ওটা!
চশমাটা খুলে দু আঙুলে দুই চোখের সংযোগস্থলটা একটু চেপে ধরেন ফার্নান্দো, ফের চশমাটা পরে নেন। তারপর ধীর এবং অনুচ্চ গলায় শুরু করেন, এই কথাটা বলার জন্যেই এত বিশদে ঘটনাগুলো তোমাকে জানাচ্ছি মার্ট। মিগুয়েলের একটি ডায়েরি আমি উদ্ধার করি কয়েকবছর আগে। তার সঙ্গে আর একটি গোটানো ডিক্লারেশন পাই, লিওনার্দো বলে আমাদেরই এক পূর্বপুরুষের লেখা একটি ঘোষণাপত্র। রডরিগো মারা যাওয়ার পর বাকি সারা জীবন ধরে আমি এই অভিশাপ ও তার থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় খুঁজে ফিরেছি। তুমি তো জানোই আমার নিজেরই উৎসাহ আছে এই বিষয়ে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার একটি মাত্র উপায়ই আছে এবং তা কোনও অলৌকিক আধিদৈবিক উপায়। সাধারণ মানুষী উপায়ে এর কোনো সমাধান সম্ভব নয়।