এই দেরাজে এমন কিছু জিনিস আছে যা অমূল্য, মানে আক্ষরিক অর্থেই তার কোনো দাম হয়না। তার দ্বিতীয় জোড়া থাকা তো সম্ভবই নয়, আর ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক, ধর্মীয় বা সামাজিক দিক থেকেও সেসব জিনিসের অভিনবত্ব বা স্বাতন্ত্র্য। অদ্বিতীয় বললে কম বলা হয়। ফার্নান্দো একবার মার্টিনেজকে বলেছিলেন এর কথা। এখানে এমন দুটি প্রামাণ্য পুথি আছে যার জন্যে ক্রিশ্চিয়ানিটির ইতিহাস সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়ে নতুন করে লেখা যায়। রয়েছে কাপড়ের ওপর চারকোল আর বিভিন্ন জৈব রঙে আঁকা এমন একটি পোর্ট্রেট যা বোধহয় প্রভু যিশুর, খুব সম্ভবত মেরি ম্যাগদালেনের আঁকা। সেখানে যিশুর চুল কোঁকড়া কালো, নাক থ্যাবড়া, কপাল উঁচু আর দুচোখে আশ্চর্য মায়াময় দৃষ্টি। অথবা মধ্যপ্রাচ্যের অসামান্য প্রতিভাধর বৈজ্ঞানিক ইবনে সিনা বা আভিসেন্নার নিজের হাতে লেখা চিকিৎসাবিদ্যার ওপর একটি পূর্ণাঙ্গ বই, যার কথা আজও কেউ শোনেনি।
মার্টিনেজ এসব নিয়ে কোনোদিনই কোনোই উৎসাহ দেখাননি। কিন্তু আজকের মার্টিনেজ সেই সেদিনের মার্টিনেজ নয়। সকালে মিজেরাকদিয়াতে আইসিইউ-র সামনে। কাটানো কয়েকটা ঘণ্টা লোকটাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। তিনি আজ তিয়াগোকে বাঁচাবার জন্যে দরকার হলে বুজরুকিতেও বিশ্বাস করতে রাজি!
ফার্নান্দো এসে সামনের চেয়ারে বসলেন। তারপর একটা লাল রেশমে জড়ানো। চৌকোনো কিছু একটা রাখলেন টেবিলের ওপরে।
রেশমের কাপড় খুলে বেরোলো একটি হাতির দাঁতে তৈরি বাক্স, যার গায়ের অসামান্য অলংকরণ দেখলে এর দুষ্প্রাপ্যতা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়।
সেই হাতির দাঁতের বাক্সের ডালা খুলে বাক্সটা মার্টিনেজের দিকে ঘুরিয়ে দেন। ফার্নান্দো, কথা ছিল মিগুয়েল এইটা হস্তগত করে তখনকার পোপতৃতীয় জুলিয়াসের হাতে তুলে দেবেন। কিন্তু যখন ওই ঘটনা ঘটে তার কয়েকবছর আগেই পোপ মারা যান। মিগুয়েল আর কোনোদিন জিনিসটা পোপের হাতে তুলে দিতে পারেননি, তার অবশ্য যথেষ্ট কারণ ছিল, বলে সাময়িকভাবে চুপ করেন ফার্নান্দো।
ততক্ষণ ধরে নিবিষ্টমনে বাক্সের মধ্যে সযত্নে রক্ষিত বস্তুটিকে দেখছিলেন মার্টিনেজ। তার সেই একাগ্রদৃষ্টি দেখে বোঝার উপায় ছিল না তার কানে ফার্নান্দোর কথাগুলো যাচ্ছে, না যাচ্ছে না!
এই তা হলে সেই? এর জন্যেই তার পরিবারের ওপর রক্ত আর অর ডানা মেলে আছে এক পাঁচশো বছরের প্রাচীন অভিশাপ? এর জন্যেই তার তিয়াগো আজ কোমাতে? খানিকটা অবিশ্বাসের সঙ্গেই চুপ করে তাকিয়ে ছিলেন তিনি।
জিনিসটা মুঠোর মধ্যে ধরা যায় এমন একটা পাথুরে কিছু। আকারটা ডিমের মতন গোলাকার, তাও একটু অদ্ভুত। আর কালো, মানে কুচকুচে কালো। এমন স্ফটিককালো মসৃণ পাথর আর দেখেননি মার্টিনেজ।
না শুধু কালো নয়। আরও একটা কিছু আছে ওর মধ্যে, মনে হল মার্টিনেজের। হীরের থেকে যেমন উজ্জ্বল দ্যুতি বার হয়, এই কালো পাথরটা থেকেও যেন তেমনই একটা ঘনকৃষ্ণ উজ্জ্বল অন্ধকার বিচ্ছুরিত হচ্ছে। আহা, কালোরও যে এত মনোহারী ঔজ্জ্বল্য হয়, অন্ধকারেরও যে এমন চোখ ধাঁধানো রূপ হয় সে মার্টিনেজ আজ অবধি কখনও দেখেননি। তিনি নির্নিমেষ এর দিকে চেয়েছিলেন, তাকিয়ে ছিলেন মোহগ্রস্তের মতন।
ডান হাত বাড়িয়ে তিনি জিনিসটাকে হাতে তুলে নিলেন, সঙ্গে সঙ্গে দুটো জিনিস অনুভব করে সামান্য শিউড়ে উঠলেন। এক, জিনিসটা তার আকারের তুলনায় ভারী। শুধু ভারী নয়, একই আকারের লোহার তুলনায় কম করে চার থেকে পাঁচগুণ ভারী। দুই, বস্তুটি শুধু ভারী নয় শীতলও বটে, এমনকি হিমশীতল বলেও কম বলা হয় তাকে। এতদিন ধরে হাতির দাঁতের বাক্সে বন্দি হয়ে দেওয়ালে গাঁথা দেরাজে থেকে ওই শৈত্য সম্ভব নয়। স্পর্শ মাত্রেই এই কঠিন শৈত্য চৈতন্যে অশরীরী বোধ জাগ্রত করে।
জিনিসটা হাতে তুলে চোখের আরও কাছাকাছি আনলেন মার্টিনেজ। আর তখনই আরও তিনটি জিনিস লক্ষ করে আশ্চর্য হলেন তিনি।
এই মুঠোর মধ্যে ধরতে পারা বস্তুটির গা মসৃণ। বোধহয় বলা ভুল হল; মসৃণ নয়, অবিশ্বাস্য রকমের মসৃণ।পর্তুগালের সেরা কম্যান্ডো নেতা হওয়ার খাতিরে মার্টিনেজকে আরও বিবিধ কৃত্রিম পদার্থের কার্যকারিতা ব্যবহার করে দেখতে হয়, সেসব সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু মার্টিনেজ হলফ করে বলতে পারেন যে এই বস্তুটি তাঁর অভিজ্ঞতায় সম্পূর্ণভাবে নতুন।
আর দ্বিতীয়টি হল, যেটাকে তিনি ঘনকৃষ্ণ কালো বলে মনে করছিলেন, কাছে আনলে দেখা যাচ্ছে যে তার সারা গা জুড়ে বিদ্যুতের মতন খেলে যাচ্ছে এক রক্তলাল আভা। খুবই সূক্ষ সেই লাল রঙের আলোর নাচন, কিন্তু এই প্রথম মার্টিনেজের মনে হল জিনিসটা জ্যান্ত! ওর মধ্যে প্রাণ আছে, আর এই তড়িগতি বিদ্যুৎশিখাই তার চিহ্ন।
সামান্য শিউড়ে উঠে জিনিসটা রেখেই দিতেন মার্টিনেজ, এমন সময় তিনি এর আকারটি লক্ষ্য করলেন। আর তার মনে হল যেন এই আকার বা আকৃতি তিনি আগে কোথাও দেখেছেন। কোথায় দেখেছেন উনি? ভুরু কুঁচকে ভাববার চেষ্টা করলেন।
কংক শেল, যেন মার্টিনেজের মনের কথা ভেবেই বলে উঠলেন ফার্নান্দো, হিন্দুরা বলে শঙ্খ, হিন্দুদের কাছে পবিত্রতম ধর্মীয় বস্তুগুলির মধ্যে একটি। এই স্পেশ্যাল বস্তুটি এক্সাক্টলি একটি শঙ্খের আকারের। শুধু তাই নয়, এর একটি স্পেশ্যালিটি আছে, এর মাথাটা চোখের সামনে ধরো।