ফের শুরু করেন ফার্নান্দো, আমাদের আফ্রিকান কলোনিগুলিতে উনিশশো ঊনষাট সালে একটা অঘটন ঘটে যায়।
পশ্চিম আফ্রিকাতে আমাদের কলোনি ছিল গিনি বিসও। বিসও-এর প্রধান পোর্ট ছিল জেবা নদীর মোহনায়, পোর্ট অফ বিসও। তবে লোকে চিনত পোর্তো পিজিগুইতি বলে।
মার্টিনেজ জানেন এরপর কীসের কথা আসবে, তবুও চুপ করে রইলেন তিনি।
ঘটনার বছর তিনেক আগে গিনি ও কেপ ভার্দে একটি পোর্তুগীজ বিরোধী। বিদ্রোহী বাহিনী তৈরি হয়, আফ্রিকান পার্টি ফর দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্স অফ গিনি অ্যান্ড কেপ ভার্দ, ছোট করে বলতে গেলে পাইজিসি।
এই পাইজিসির প্ররোচনায় ওই বছর পোর্তো পিজিগুইতির ডক শ্রমিক ও মজদুররা মজুরি বাড়ানোর দাবিতে ধর্মঘট করে। ব্যাপারটা আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে নেওয়া উচিত ছিল কিন্তু তার বদলে যা করা হয় তা অত্যন্ত লজ্জাজনক।
এতটা বলে ফার্নান্দো ফের থামেন, একটু জল খেয়ে নেন। তারপর ভুরু কুঁচকে কী যেন ভেবে নিয়ে ফের শুরু করেন তুমি তো জানোই আমাদের বাবা চাকরি করতেন। পুলিশে। তখন তিনি ছিলেন একটি বিশেষ পুলিশ বাহিনীর, যার মান পিআইডিই, তার অন্যতম কর্তাব্যক্তি। এখন আর এর অস্তিত্ব নেই, তখনকার প্রধানমন্ত্রী অলিভিয়েরা সালাজার বিশেষ আদেশবলে এই বাহিনী তৈরি করেন।
ওই ধর্মঘটের সময় বাবা তখন পিদজিগুইতিতে পোস্টেড। তার একসপ্তাহ আগেই তিনি ওখানে গেছেন, সঙ্গে ফ্রান্সিসকোও। আমি মায়ের সঙ্গে মামার বাড়িতে আছি, ভিয়েনাতে। আচমকাই পিদজিগুইতির পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে পড়ে।
দিনটা ছিল তেসরা অগাস্ট। পাইজিসির নেতারা এই ধর্মঘটের পিছনে মদত দিচ্ছে জেনে লিসবনের পিআইডিইর হেডকোয়ার্টার থেকে আদেশ যায় যে কোনো মূল্যে ধর্মঘট ভাঙতে। বাবা আলোচনার মাধ্যমে ব্যাপারটা মিটিয়ে নিতে ইচ্ছুক ছিলেন, কিন্তু লিসবন শুনতে রাজি ছিল না। বাবা বাধ্য হয়ে গুলি চালানোর আদেশ দেন।
এর পর দুজনেই চুপ করে থাকেন। এতটা বলার দরকারই ছিল না মার্টিনেজকে, এসবই জানেন তিনি। পিদজিগুইতি ম্যাসাকার পর্তুগালের ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। এই গুলিচালনার ফলে সেদিন কমপক্ষে পঞ্চাশজন ডক শ্রমিক মারা যান। মার্টিনেজ খুব ভালো জানেন তার ঠাকুর্দার কী ভূমিকা ছিল সেইদিন। এখনও মাঝেমধ্যে পর্তুগালের রাজনৈতিক আলোচনার আসরে এই গণহত্যার কাহিনি উঠে আসে, চুলচেরা বিশ্লেষণ হয় সেই নিয়ে।
কিন্তু তার সঙ্গে ফ্রান্সিসকোর মৃত্যুর কী সম্পর্ক?
এইবার ঘোলাটে চোখ তুলে তাকালেন বৃদ্ধ, সেই দিন রাতেই মারা যায় ফ্রান্সিস। বাবা ওকে কোয়ার্টারে রেখে গেছিলেন, সঙ্গে শুধু একজন আফ্রিকান মহিলা অ্যাটেন্ডেন্ট ছিলেন। মধ্যরাত্রে বাবা ক্লান্ত শরীরে টলতে টলতে ফিরে দেখেন দরজা খুলছে না কেউ। শেষে দরজা ভাঙতে হয়। দরজার কাছেই সেই মহিলা অ্যাটেনডেন্টের মৃতদেহ পড়েছিল, আর রান্নাঘরের সামনে মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছিল ফ্রান্সিস। বাবার কোলে মাথা রেখে রেখেই মারা যায় সে, তার আগে অত্যন্ত কর্কশ ও অপরিচিত গলায় শুধু বলে যায়, পাপের বেতন মৃত্যু, চাবুকের বেতন রক্ত। তারপরেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে আমার দাদা।
এইবারে সোজা হয়ে বসেন মার্টিনেজ, স্পষ্টতই ফ্রান্সিসকো মৃত্যু আর তিয়াগোর অসুস্থ হওয়ার ঘটনা দুটোর মধ্যে আশ্চর্যরকম সাদৃশ্য আছে। কিন্তু…
যেন মার্টিনেজের মনের কথা জেনেই বলে যেতে থাকেন ফার্নান্দো, সেবারেও কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি, না ফ্রান্সিসের শরীরে, না সেই মহিলা। দুজনের মুখই অজানা আতঙ্কে ভয়াবহ রূপ ধারণ করে ছিল। আর একটা বিশ্রী পচা গন্ধ অনেকক্ষণ সেই ঘরে রয়ে গেছিল।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকেন মার্টিনেজ। এর মানে কী?
এরপর এক অদ্ভুত ভৌতিক স্বরে ফিসফিস করে বলে ওঠেন ফার্নান্দো, আমি জানি তুমি কী ভাবছ মার্টিনেজ। আজ তোমাকে সব বলব বলেই ডেকেছি। জানি না তুমি জানো কি না, বা লক্ষ করেছে কি না, আমাদের ফ্যামিলিতে কারও বড়ো ছেলে বাঁচে না। কোনো না কোনো অপঘাতে মারা যায়। শুধু অপঘাত নয়, প্রতিটি ব্যাখ্যাহীন দুর্ঘটনা। সেই থেকে আমাদের পরিবারে অলিখিত নিয়ম দুটি সন্তানের জন্ম দেওয়া, সে ছেলে হোক বা মেয়ে। আমরা জেনেই এসেছি যে আমাদের জ্যেষ্ঠ সন্তানটিকে হারাতে হবে এবং তার কোনো কারণ থাকবে না। সেইজন্যই যখন একটি সন্তানের জন্ম দিয়ে সিসিলিয়া মারা গেল, তোমাকে আরেকটা বিয়ে করতে বলেছিলাম। কারণ আমি জানতাম, তোমার মাও জানত যে তিয়াগো বাঁচবে না, বাঁচতে পারে না। মার্টিনেজ শুনলেন, কিন্তু কিছুই বুঝলেন না। শক্ত মানুষ তিনি, বীরশ্রেষ্ঠ, কম্যান্ডোশাস্ত্রে মহারথী। তিনিও এর কোনো থই পেলেন না। চোয়াল শক্ত করে। খরদৃষ্টি মেলে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
এই বার ফার্নান্দোর মুখে যেন সারা শরীরের রক্ত এসে জমা হল। কোনো এক অব্যক্ত উত্তেজনায় ফেটে পড়তে চাইল সেই বৃদ্ধের সমস্ত শরীর, এবার যখন তিনি মুখ খুললেন মনে হল ফার্নান্দো ভাঁজ নয়, যেন এক অলৌকিক দৈবস্বর কথা বলে উঠল, তোমাকে কখনও বলিনি মার্ট, কারণ তুমি এসবে বিশ্বাস কর না। কিন্তু তবুও বলছি। শোনো, আমাদের পরিবারের ওপর একটি অতি প্রাচীন অভিশাপ আছে, প্রায় পাঁচশো বছরের পুরোনো অভিশাপ। পুরুষানুক্রমে আমরা সেই অভিশাপের ব্যাপারে জেনে এসেছি এবং তার উত্তরাধিকার বহন করে চলেছি। এই অভিশাপের জন্যে আমাদের পরিবারের কোনো জ্যেষ্ঠ সন্তান বাঁচে না।