প্রায় অর্ধশতক আগে আলবুকার্ক নামের এক যবন সেনাপতি আদিল শাহি শাসন হটিয়ে যাবনিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু এই জয় এত সহজে আসত না, যদি না বিজাপুরি সুলতানশাহি দ্বারা বিতাড়িত এক হিন্দু গোষ্ঠী অধিপতি, নাম তিমায়া, এই বিদেশি যবনদের সম্পূর্ণ সহায়তা দিত। তাতেও আপত্তি ছিল না ত্রিলোচনের, ধর্মেকর্মে হাত না পড়লে এ সব নিয়ে বিশেষ ভাবেননি উনি। রাজা রাজকর্ম পালন করবেন, পণ্ডিত কুলধর্ম, এই তো নিয়ম।
কিন্তু এই বিদেশি যবনরা বড় নূর, নিষ্ঠুর আর নির্মম অত্যাচারী। ইউসুফ আদিল। শাহ বিধর্মী শাসক ছিলেন বটে, কিন্তু এদেশেরই ছিলেন। পার্থক্যটা শুধু ধর্মেই ছিল, পাশাপাশি বাস করায় নয়, বিজাপুরি সুলতানশাহি হিন্দুদের ধর্মেকর্মে হাত দেয়নি। কখনো।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ত্রিলোচন। তিমায়া, হে তিমায়া, মুসলমান রাজত্ব শেষ করার। উদগ্র বাসনায় কী সর্বনাশ করলে তুমি? খাল কেটে এ কোন কুমির আনলে? এই বিদেশি। যবনদের হাতে মহাসর্বনাশের কোন নতুন অধ্যায় শুরু হতে চলেছে গোয়াপুরীতে, তার আচ কিছু কিছু এখনই পেতে চলেছে গোঁয়ার হিন্দু আর মুসলমানরা।
চোখ বুজলেন ত্রিলোচন।
.
২০১৬। জুলাই। উত্তর আফগানিস্তান।
মাথা নিচু করে নিজের ল্যাপটপে ডেইলি রিপোর্ট টাইপ করছিলেন কর্নেল মার্টিনহো ভাজ। রোজের রিপোর্ট রোজ যাওয়াটাই নিয়ম।
বিরক্তি লাগছিল কর্নেল ভাজের। মাথা তুলে ঘাড়টা এদিক ওদিক করে জড়তা ছাড়িয়ে নিলেন উনি। শরীরটা পেছন দিকে ধনুকের মতন বাঁকিয়ে একটা আড়মোড়া ভাঙলেন। তারপর এগিয়ে গেলেন জানলার দিকে।
জানলার বাইরে অপূর্ব দৃশ্য। বিকেলের পড়ন্ত রোদে হিন্দুকুশ পর্বতমালার বিস্তীর্ণ। রেঞ্জ পুরো দৃষ্টিসীমা জুড়ে ঝলমল করছে। মার্টিনহো জানেন, এই রেঞ্জের ওপারেই তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান আর তাজিকিস্তান। তুর্কমেনিস্তান থেকে বয়ে এসেছে আমুদরিয়া। স্ট্র্যাটেজিক্যালি এমন ইম্পর্ট্যান্ট প্রদেশ মধ্য এশিয়াতেও কমই আছে। তাই এই বলখ প্রদেশের প্রধান শহর মাজার-ই-শরিফ স্মরণাতীত কাল থেকেই এত গুরুত্বপূর্ণ, মিলিটারি স্ট্রাটেজির দিক দিয়ে। এই শহর দখল করতে পারলেই কেল্লা ফতে। হেরাত, কুন্দুজ আর কাবুল, তিনটেতেই ঢোকার পথের ওপর প্রশ্নাতীত আধিপত্য, বলতে। গেলে, সমগ্র উত্তর আফগানিস্তান আর হিন্দুকুশ রেঞ্জ হাতের মুঠোয়।
আফগানিস্তানের এই বলখ প্রদেশ পুরো পাহাড়ি অঞ্চল, যেমন উঁচু, তেমন শুকনো। সর্বোত্তম মাউন্টেন ওয়ারফেয়ারের ট্রেনিং না থাকলে এই পাহাড়ি অঞ্চলে ঘাঁটি গেড়ে বসে যুদ্ধ বা ছায়াযুদ্ধ, দুই-ই চালিয়ে যাওয়া কঠিন।
মদু হাসলেন মার্টিনহো।কঠিন কাজটাই তো করার জন্যে ওঁরা রেঞ্জার্স।পোর্তুগালের বিশেষ কম্যান্ডো ফোর্স স্পেশাল অপারেশনস টুপ সেল্লো দে ত্রোপাস অপেরাশোস এসপেশিয়ালসের বা সিটিই-র উজ্জ্বল নক্ষত্র মার্টিনহো ভাঁজ জানেন, যে কোনো কমব্যাট পরিস্থিতিকে মুহূর্তে নিজের সপক্ষে নিয়ে আসতে সিটিই-র রেঞ্জার্সদের সমকক্ষ বলতে শুধু ইউএস এর ডেল্টা ফোর্স বা ইউকের স্যাস। অবশ্য ইজরায়েলের সায়ারেত মটকাল বাইন্ডিয়ার মাকোসেরও খুব প্রশংসা শুনেছেন মার্টিনহো । রেঞ্জার্সদের ছাড়া, এই শত্ৰুবেষ্টিত সঙ্কুল জায়গায় ন্যাটোর রেজোলিউট সাপোর্ট মিশনের পার্ট হয়ে এই টাফ কভার্ট অপারেশনস কজন পালন করতে পারত, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
বিরক্ত হয়ে যাচ্ছেন মার্টিনহো। তালিবান, আলকায়েদা এসব এদিকে অনেকটাই ঠান্ডা।এখন যা অ্যাকশন তো সিরিয়া আর ইরাকে। অ্যাকশনের মানুষ তিনি, বসে বসে রিপোর্ট পাঠাতে পাঠাতে শরীরে জং ধরে গেল। আহা, দু চারটে আইসিস জঙ্গি ধরে ইন্টারোগেট করবেন, তবে না সুখ। দু-চারটে ইয়েজিদি মেয়েদের হাতের কাছে পেয়ে নিজেদের খুব বীরপুঙ্গব ভাবছে এই জাহান্নমের শয়তানগুলো…
ভাবতে ভাবতেই অত্যাধুনিক লোরান সিস্টেমসের ভিডিও স্ক্রিনটা ব্লিঙ্ক করতে থাকে, ইনকামিং কলের সিগন্যাল ভেসে আসে। দ্রুত টেবিলের কাছে ফিরে আসেন মার্টিনহো। সামান্য বিস্ময়ে দ্রুদুটো ওপরে ওঠে, তারপরেই স্বাভাবিক হয়ে অ্যাক্সেস্টেন্স বাটনটা টেপেন উনি।
হেডকোয়ার্টার ল্যামেগো থেকে কল, অন মোস্ট সিকিওরড চ্যানেল। সামথিং মাস্ট বি গোয়িং হরিবলি রং… ভাবতে ভাবতেই অভ্যস্ত গলায় বলেন, রেঞ্জার্স ফিফটিথ্রি আল্ফা হ্যাশ। গুড আফটারনুন কমান্ডান্ট।
স্ক্রিনে সিটিই-র প্রধানের কঠিন চৌকো খুনি মুখটা ভেসে ওঠে। এমনিতে ঠান্ডা মাথার লোকটাকে বেশ উত্তেজিত লাগে, আজ। প্রতি অভিবাদনের ধার ধারেন না, রেঞ্জার্স টুয়েন্টি নাইন ল্যামডা কাঁপা। কর্নেল, আপনার কাছে ঠিক তেরো মিনিট সময় আছে টু রিচ আলিয়াবাদ স্কুল, হুইচ ইজ আন্ডার সিজ ফ্রম সাম ফ্যাকশনস অফ তালিবান। ক্লোজ টু ওয়ান হান্ড্রেড স্টুডেন্টস ইনক্লডিং ফিউ টিচার্স আর টেকেন। ক্যাপটিভ। টোটাল সিক্স মিলিট্যান্টস আর ইন অ্যাকশন।
প্রথমে চমকে ওঠেন, তার পরেই ঘেন্নায় চোয়ালটা শক্ত হয়ে ওঠে মার্টিনহোর। এই বেজন্মাগুলো এখন বাচ্চাদের ওপর পৌরুষ ফলাতে গেছে। বাঞ্চ অফ মোরোনস। সামনাসামনি লড়ার দম নেই এই বাস্টার্ডসদের, যত বীরত্ব নিরস্ত্র নিরীহ লোককে ক্যামেরার সামনে হত্যা করার সময়। ঘেন্নায় আর রাগে গাটা রি রি করে ওঠে মার্টিনহোর, আজ এদের এক-একটাকে ধরে ধরে…।