ভাজ পরিবারের পারিবারিক ডাক্তার এসে পৌঁছান এগারো মিনিটের মাথায়। তারই পরামর্শ মতন অচৈতন্য তিয়াগোকে আধঘণ্টার মধ্যে ভর্তি করা হয়। মিজেরিকর্দিয়াতে।
ডাক্তাররা চিকিৎসার ত্রুটি করেননি বলাই বাহুল্য। প্রথমে বিভিন্ন রকম প্রাথমিক স্টিমুলাস দিয়ে সাড়া না পেয়ে শরীরের অত্যন্ত সংবেদনশীল জায়গায় আঘাত করে দেখা হয়। তারপর এক্স রে, আন্ট্রাসাউন্ড, ইসিজি, এম আর আই, সিটি স্ক্যান থেকে শুরু করে ইএমজি, মায়েলোগ্রাম, নিউরোসোনোগ্রাফি যাবতীয় ভাবে তন্নতন্ন করে খুঁটিয়ে দেখা হয়েছে ওই দশ বছর বয়সি শিশুটির শরীর। ইতিমধ্যেই পর্তুগালের ইন্সতিতুতো নাসিওনাল দে এমার্জেন্সিয়া মেডিকা থেকে উঠিয়ে আনা হয়েছে দেশের সেরা ট্রমাবিশেষজ্ঞ ডক্টর ওরল্যান্দো হার্নান্দেজকে।
তিনি অনেক চেষ্টা করেও সাড়া না পেয়ে জানান যে ইতিমধ্যেই সেই হতভাগ্য শিশু আচ্ছন্ন হয়েছে গভীর কোমাতে! ফল, দ্রুত আই সি ইউতে স্থানান্তরণ!
কিন্তু না, তিনিও বলতে পারলেন না, কোন আকস্মিক দুর্ঘটনার বলি হল এই নিষ্পাপ প্রাণোচ্ছল বালক!
বলা বাহুল্য এরপর লন্ডন থেকে ইওরোপের সেরা পেডিয়াট্রিশিয়ানকে উড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয়। এর সঙ্গে সঙ্গেই তিয়াগোর জন্যে গঠিত মেডিক্যাল বোর্ড আমেরিকার জন হপকিন্স, বস্টন চিলড্রেনস হসপিটাল ও সেইন্ট জুড চিলড্রেনস হসপিটালের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
ফার্নান্দো আর মার্টিনেজ অনেকক্ষণ চুপ করে বসে ছিলেন। বাইরে একটা জ্যাকারান্ডা গাছের ডালে অনেকক্ষণ ধরে একটা উডকক পাখি বিষণ্ণ সেই দুঃখবিকেলের সঙ্গে মানানসই ক্লান্ত একঘেয়ে সুরে ডেকে যাচ্ছিল। তার পর সে উড়ে গেলে নৈঃশব্দ। ভেঙে প্রথম কথা বললেন ফার্নান্দো, আমি সত্যিই দুঃখিত মার্ট। কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না।
থমথমে মুখে তুলে তাকালেন মার্টিনেজ, গলা ঝেড়ে বললেন, জানি পাপাই, ডাক্তাররাও যখন কিছু বুঝতে পারছেন না…
আবার বেশ কিছুক্ষণের স্তব্ধতা। তারপর যেন অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়িয়ে অত্যন্ত ক্ষীণ স্বরে ফার্নান্দো বললেন, একটা কথা ছিল মার্ট। অনেকদিন ধরে তোমাকে বলব বলব। ভেবেও চেপে রেখেছি। তোমার মা অবশ্য অনেক আগেই তোমাকে জানিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু আমি ঠিক সাহস পাইনি। কিন্তু নিয়তিকে আর কদিন ঠেকিয়ে রাখা যায় বল? আজই সেইদিন, আজই যদি তোমাকে সব খুলে না বলি, একটা বড় অঘটন হয়ত আর এড়ানো যাবে না।
অবাক বিস্ময়ে মুখ তুলে নিজের বাবার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চাইলেন মার্টিনেজ। কিছু বলতে হল না, ওই নজরেই প্রশ্নটা লেখা ছিল স্পষ্টাক্ষরে।
কিছুক্ষণ ইতস্তত করলেন ফার্নান্দো, তারপর গলা ঝেড়ে বললেন, মার্ট, এই মুহূর্তে এই কথাটা বলার জন্যে ইশ্বর আমাকে ক্ষমা করুন, কিন্তু তোমার কি মনে আছে, সিসিলিয়া মারা যাওয়ার পর আমরা তোমাকে আরেকবার বিয়ে করতে বলেছিলাম?
একটু বিরক্তই হলেন মার্টিনেজ, পাপাই, এখন কি এসব আলোচনা করার সময়? আমি তো বলেইছিলাম তখন, আমি চাই না অন্য কোনো মহিলাকে মা বলে মানিয়ে নিতে তিয়াগোর কোনো সমস্যা হোক। বার বার একই কথা বলে, তাও এই সময়ে…
হাত তুলে মার্টিনেজকে থামালেন ফার্নান্দো, আমি জানি মার্ট, সেটুকু ঔচিত্যবোধ তোমার বাবার আছে বলে বিশ্বাস রাখতে পার।এই শোকের আবহের মধ্যেও এই কথা বলছি তোমাকে, নিশ্চয়ই তার পিছনে কারণ আছে?
ফার্নান্দোর স্বরে এমন কিছু একটা ছিল যে মার্টিনেজ সোজা হয়ে বসলেন, তার চোখে সেই কম্যান্ডোসুলভ খরদৃষ্টি ফিরে এল, কী বলতে চাইছে পাপাই? স্পষ্ট করে বলো তো।
জানালার বাইরে দিয়ে উদাস দৃষ্টি মেলে দেন ফার্নান্দো। এই রাজসিক প্রাসাদের অনেক বাইরে নাগরিক লিসবনের জীবনযাত্রা অখণ্ড স্রোতের মতো বয়ে চলেছে। সেই প্রবহমান চঞ্চল উচ্ছলতার মধ্যে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে জেগে আছে এই বাড়ি, আর সেই বাড়ির চারিদিক জুড়ে কালই নেমে এসেছে এক বিষাদ অমঙ্গলছায়া। কে জানে, কবে তার থেকে পরিত্রাণ মেলে এই কটি জীবন্মুত প্রাণীর!
ফিরে তাকান ফার্নান্দো, তারপরে নিচু অথচ স্পষ্টস্বরে বলেন, তোমার কি। রডরিগোর কথা মনে পড়ে মার্ট?
মুহূর্তে যেন কেউ হ্যাঁচকা টান মেরে মার্টিনেজকে তারই নিজের অমলিন শৈশবের। সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। মুহূর্তে কয়েকদশক পিছনে চলে গেলেন তিনি।
রডরিগো ছিল মার্টিনেজের সহোদর বড় দাদা, একই সঙ্গে ফ্রেন্ড ফিলোজাফার অ্যান্ড গাইড। পাঁচ বছরের বড় এই দাদাটিকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসতেন মার্টিনেজ। পোর্তুগালের সেরা স্কুল সেইন্ট ডোমিনিকে পড়ত রডরিগো, গত কয়েকবছর ধরে ওখানেই পড়াশুনা করে আসছে ভাঁজ পরিবারের ছেলেমেয়েরা। সেখানেও অল্পবয়সেই শিক্ষকদের নজর কেড়েছিল রডরিগো। পড়াশোনায় যেমন তুখোড় ছেলে ছিল সে, খেলাধূলায় তেমনই অসামান্য প্রতিভার অধিকারী। স্কুলের যাবতীয় কুইজ কম্পিটিশন জেতা থেকে শুরু করে অ্যাক্টিং ক্লাসে অসামান্য অভিনয়প্রতিভা দেখিয়ে সবার তাক লাগিয়ে দিয়েছিল সে। তার ওপর তার আর্ট অ্যান্ড ক্রাফটস ক্লাসের নৈপুণ্য দেখে শিক্ষকরাও স্তম্ভিত হয়ে যেতেন।
বড় দাদাটিকে হিরো জ্ঞানে প্রায় পুজোই করতেন মার্টিনেজ। দুজনে মিলে প্ল্যান করতেন বড় হলেই একটা বড় জাহাজ চুরি করে নতুন মহাদেশ আবিষ্কার করতে বেরিয়ে পড়বেন, ক্রিস্টোফার কলম্বাস, বার্থালোমিউ দিয়াজ আর ভাস্কো দি গামার পর মহাপরাক্রান্ত সমুদ্রজিৎ হিসেবে অক্ষয় হয়ে থাকবে এই দুই ভাইয়ের নাম। প্ল্যান করতেন ফাইটার প্লেন চালানোর। কত বিকেল, কত সন্ধে দুই ভাইয়ের কেটেছে ক্রুসেডার বা নাইট টেম্পলার সেজে লড়াই করার মধ্যে দিয়ে…