আর কোথা থেকে হঠাৎ করে একটা পচা মৃতদেহের কটু গন্ধ ঘিরে নেয় সমস্ত স্থানটিকে। তারপর সেই দুর্গন্ধ দ্রুত বেড়ে ওঠে অনেকগুণ, আর অলৌকিক খলখল। হাসির শব্দে ভরে চারিদিক। যেন হাজারে হাজারে স্থলিতমাংস, গলিতদেহ প্রাচীন। মৃতদেহের সারি পাতালের হিম অন্ধকার থেকে উঠে এসে এই স্থানটিকে ঘিরে নাচতে থাকে। তাদের হাড়ের খটখট শব্দ মিশে যায় ঝোড়ো ঘূর্ণি হাওয়ার ক্রুদ্ধ গর্জনের সঙ্গে।
শুকনো কাঠ আর ঝোড়ো হাওয়া, তিনটি স্তূপই জ্বলে উঠতে সময় নেয়নি বেশি। আর সেই দাউদাউ আগুনের মধ্যে দিয়ে ভেসে আসে মহাবেতালসাধক, অঘোরীতন্ত্রশ্রেষ্ঠ ত্রিলোচন ক্ষেমকল্যাণীর স্বর। সেই জ্বলে ওঠা আগুন পেরিয়ে, স্বর্গমর্ত্যপাতাল ভেদ করে, উত্তাল ঝড়ের শোঁ শোঁ শব্দের মধ্যে দিয়ে মিগুয়েল ভাজের দিকে ভেসে আসে একটা অতিলৌকিক কর্কশ কণ্ঠস্বর, শোন রে পাপাত্মা হানাদার যবন, আমি ত্রিলোচন। ক্ষেমকল্যাণী, আমার পিতৃকুল ও মাতৃকুলের নামে, স্বর্গ ও নরকের নামে, ত্রিলোক ও একাদশ রুদ্রের নামে অভিশাপ দিচ্ছি যে- তোর পরিবারের প্রতিটি প্রথম সন্তান অশেষ কষ্ট পেয়ে মৃত্যুর মুখ দেখবে, যেভাবে তোরা কষ্ট দিয়ে মেরেছিস আমার একমাত্র সন্তানকে। সৃষ্টির শেষ দিন পর্যন্ত তোর উত্তরপুরুষদের তাড়া করে ফিরবে নিয়তি, ততদিন পর্যন্ত এই শাপ থেকে তোদের মুক্তি নেই নেই নেই…
.
২০১৬। জুলাই। লিসবন।
লিসবন শহরের সবচেয়ে অভিজাত পল্লিটির নাম পাখে দাস নাসোয়েস। তার শেষ প্রান্তে যে বাদামি রঙের প্রাসাদোপম বাড়িটি পর্যটক মাত্রেরই সম্ভ্রম এবং পোর্তুগালের ধনীতম ধনীদের ঈর্ষামিশ্রিত তারিফের উদ্রেক করে, তার নাম ভাঁজ পালাসেতে, অর্থাৎ ভাঁজ প্যালেস।
এক বিষণ্ণ বিকেল সেই প্রাসাদের দোতলার ঘরে একটি ছোট ভিক্টোরীয়। গোলটেবিলের দুপাশে বসেছিলেন দুই পুরুষ, একজনের বয়েস সত্তরের কোঠায়, আরেকজনের বয়েস চল্লিশের কাছাকাছি।
খুব ভোরবেলায় লিসবনের আমাডোরা মিলিটারি এয়ারবেসে মার্টিনেজকে নিয়ে এসে ল্যান্ড করে পোর্তুগাল সেনাবিভাগের সর্বশ্রেষ্ঠ সুপারসনিক জেটটি। মাটিতে পা রেখেই তাঁর জন্যে অপেক্ষারত ল্যান্ড ক্রুজারের সিটে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়েন মার্টিনেজ। পোর্তুগালের জনবহুল রাস্তা ধরে সেই ল্যান্ড ক্রুজার প্রায় উড়েই যায়। উড়ে যায়। লিসবনের, শুধু লিসবন কেন, সমগ্র পোর্তুগালের শ্রেষ্ঠতম হাসপাতাল মিজেরিকর্দিয়া দে এভোরার দিকে।
ভাজ পরিবারের টাকার অভাব নেই বললে কম বলা হয়। গত সাতশো আটশো বছর ধরে পোর্তুগালের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ এসেছে এই পরিবার। রাজনীতি, যুদ্ধক্ষেত্র, ধর্মীয় পরিমণ্ডল সর্বক্ষেত্রে ভাঁজ পরিবারের অঙ্গুলিহেলনে পোর্তুগালের রাজপাটের পটপরিবর্তন হত।এমনকি এককালে রাষ্ট্রীয় টাকশাল ও ব্যাঙ্ক, দুটিই নিয়ন্ত্রণ করত এই পরিবার। শুধু তাই নয়, মন্ত্রীপরিষদ নিয়োগ থেকে শুরু করে সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ পদটিতে কাকে বসানো হবে সেসবও ঠিক হত এই ভাঁজ পালাসেতে থেকে। এই ওয়াই ফাঁই যুগেও পোর্তুগালের ক্ষমতার অলিন্দ ভাঁজ পরিবারের দাপট অপ্রতিহত।
আর সেই বিপুল প্রতাপশালী ভাঁজ পরিবার, যার কুবেরীর্ষিত সম্পদ সমগ্র ইওরোপে এখনও প্রবাদের মতন, তার একমাত্র উত্তরাধিকারী কর্নেল মার্টিনেজ ভাঁজ আজকে সকালে মিজেরিকদিয়া হাসপাতালের সবচেয়ে সেরা কেবিনটির কাঁচের দরজার সামনে পথের ভিখিরির মতন বসে হাউ হাউ করে কাঁদছিলেন। ইওরোপের শ্রেষ্ঠতম কম্যান্ডোদের মধ্যে একজন তিনি। সমগ্র ইওরোপ ও ইউ এস এ জুড়ে কঠিনতম কম্যান্ডো ট্রেইনিং সেশন পরিচালনা করতে যার সর্বাগ্রে ডাক পড়ে, সেই তীক্ষাগ্রবুদ্ধি, কম্যান্ডেবিক্রমে অতুল কীর্তির অধিকারী যোদ্ধৃশ্রেষ্ঠ মার্টিনেজ ভাঁজ আজ একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত সংসারী বাবার মতন চিকিৎসকের হাত জড়িয়ে ধরে তিয়াগোর প্রাণভিক্ষা চাইছিলেন।
যদিও পোর্তুগালের সেরা চিকিৎসকরা কোনো আশ্বাসবাণীই শোনাতে পারেননি। শোনানো দূরস্থান, তারা এখনও বুঝতেই পারেননি যে অসুখটা কী! দুরন্ত ছেলে দিব্যি খেলছিল পালাসেতের বাগানে, একাই। সন্ধে নামার সময় হঠাৎ অত্যন্ত ভয়ার্ত মুখে দৌড়তে দৌড়তে উঠে আসে ঠাকুর্দার কাছে। ঠাকুর্দা ফার্নান্দো তখন দোতলার বারান্দায় আরামকেদারায় বসে খুবই মনোযোগ সহকারে সোনার জলে লেখা, মরক্কো চামড়ায় বাঁধানো একটি প্রাচীন বই পড়ছিলেন। তার কাছে এসে তিয়াগো উত্তেজনা আর ভয়ে মেশামেশি আরক্তিম চোখ আর রক্তাভ মুখ নিয়ে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে, হি হ্যাঁজ। কাম, হি হ্যাঁজ কাম! আর তারপরেই মুখে গাজলা তুলে অজ্ঞান হয়ে যায়।
তৎক্ষণাৎ ফার্নান্দোর আর্তচিৎকারে যাবতীয় কর্মচারীরা জড়ো হয় দোতলার বারান্দায়। তিনি সমগ্র পালাসেতে দ্রুত তল্লাশির আদেশ দেন, আর এমারজেন্সি কল দেন পারিবারিক ডাক্তারকে।এমনিতেই জনা চারেক প্রশিক্ষিত কম্যান্ডো দুটি ভয়ালদর্শন রটওয়েলার নিয়ে চব্বিশঘণ্টাই পাহারা দেয় এই প্রাসাদ। রটওয়েলার দুটি অত্যন্ত হিংস্র ও মানুষখেকো। শোনা যায় তারা একবার ভাঁজ পালাসেতেতে ভুল করে ঢুকে পড়া এক ছিঁচকে চোরকে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ছিঁড়ে খেয়ে উদরস্থ করে। আর তা ছাড়া ভাঁজ পরিবারের অত্যাধুনিক নিজস্ব সুরক্ষা ব্যবস্থা তো আছেই। ফলে কেউ এখানে। ঢুকে কেউ কিছু একটা অপকর্ম করে নিরাপদে পালিয়ে যাবে- এরকম হতে পারে না। কিন্তু কোথাও কিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি। শুধু বাগানের এক কোণে একটা তীব্র মড়াপচা গন্ধ সার্চপার্টির নাকে এসেছিল বটে, তবে সেই দুর্গন্ধ উবে যেতে বেশি সময় নেয়নি। নাহ, সেই গন্ধের উৎস অনেক খুঁজেপেতেও পাওয়া যায়নি। আর হ্যাঁ, সেই যমদূতের মতন রটওয়েলার দুটি পোষা খরগোশের মতন জবুথবু হয়ে বসেছিল তাদের কেনেলে, অতি কষ্টেও তাদের বাগানের দিকে আনা যায়নি। কিছুতেই না!