অতি কষ্টে ডানদিকে ঘাড়টা ঘোরাতেই যেন ত্রিলোচনের ব্রহ্মরন্ধ্র দিয়ে পায়ের পাতা অবধি একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল!
মালতী, ওঁর স্ত্রী, আরেকটি খুঁটির সঙ্গে বাঁধা! তার মানে ধরা পড়ে গেছে ওরাও!
মাথার চুল কেটে ফেলা হয়েছে মালতীর, গায়ে যেটুকু কাপড় আছে তাতে কোনওমতে লজ্জা নিবারণ হয়! হাতদুটো ওপরে খুঁটির সঙ্গে লোহার বেড়ি দিয়ে বাঁধা। সারা গায়ে নির্যাতনের চিহ্ন স্পষ্ট, থেকে থেকে রক্ত জমাট বেঁধে আছে সারা শরীরে। ঠোঁটের কশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে লালা ও রক্ত। এখানে ওখানে আগুনের ছ্যাঁকা দেওয়ার দাগ। যেটুকু চুল রয়েছে, তারাও হাওয়ায় উড়ছে অভিশাপের মতন। মালতীও চেয়ে আছে এদিকে, চোখে পাগলের মতন উদভ্রান্ত দৃষ্টি। তারপর ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, অনেক রাত হল, খেতে বসবে না?
বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন ত্রিলোচন ক্ষেমকল্যাণী। হিমশীতল কী একটা যেন তার মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে গেল। এই উন্মাদিনীকে কি তিনি চেনেন? এই কি তার বড় আদরের, বড় ভালোবাসার স্ত্রী?
মালতী আরও একবার চারিদিকে তাকালেন উদভ্রান্তের মতন, তারপর হাউ হাউ করে আর্তনাদ করে উঠলেন, আমাকে ছেড়ে দাও, উঃ খুব লাগছে, ও গো তোমাদের দুটি পায়ে পড়ি, আমাকে আর মেরো না, মা গো, আর পারছি না…
গায়ের সমস্ত রোম শিউরে উঠল ত্রিলোচনের, ক্রোধে, ক্ষোভে তার সর্বাঙ্গ কঁপতে লাগল। তার সমস্ত চেতনা অবলুপ্ত হয়ে শুধু এক বিন্দুতে সংহত হতে লাগল। সমস্ত মস্তিষ্ক, সমস্ত স্নায়ু, শরীরের প্রতিটি রক্তবিন্দু শুধু একটি শব্দ ধ্বনিত করে তুলল, প্রতিশোধ চাই, প্রতিশোধ!
চাই সেই ভয়ংকরতম অভিশাপ, যা একমাত্র বেতালমন্দিরের পুরোহিতরাই জানেন গত সহস্রবছর ধরে। যে শাপের মূর্তি ধরে স্বয়ং ঈশ্বরীয় ত্রাসদল তাড়িয়ে বেড়ান সেই মহাপাতককে! যে শাপ থেকে সৃষ্টির শেষ অবধি অভিশপ্তের মুক্তি নেই!
নরকবেতালশাপ!
এইবার ধীরে ধীরে ঘাড়টা বাঁদিকে ঘোরালেন ত্রিলোচন। আর লালচোখ মেলে শুধু চেয়ে রইলেন, চেয়েই রইলেন।
বীরভদ্র, তার সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ সন্তান। তার বুকের পাঁজর, চোখের মণি, সাত রাজার ধন এক মানিক।
সেও একই ভাবে বাঁধা বটে। তবে তার সারা শরীরে একটি বই আর কোনও
আঘাতের চিহ্ন নেই। অবশ্য আঘাতের আর দরকার কী? কারণ যেভাবে সে ঘাড় মটকে আছে তাতে বোঝা যায় যে তার শরীরে বিন্দুমাত্র প্রাণও আর অবশিষ্ট নেই। আর না। থাকার কারণ সারা শরীরের সেই একমাত্র আঘাতটি!
শিশুপুত্রের যে বুকে চুমু খেয়ে স্বর্গসুখ অনুভব করতেন ত্রিলোচন, যেখানে কান। পেতে হৃদস্পন্দন শুনে হৃদয় জুড়োতেন, আজ সেই সন্তানের বুকে একটি বড় গর্ত। হা গর্ত। সাধারণ আঘাত নয়, এক পাঞ্জা চওড়া, বুক ছুঁড়ে দেওয়া গভীরতম ক্ষত। আর সেই জন্যেই বোধহয় সোনার বরণ ছেলের সারা বুকে রক্ত শুকিয়ে কালচে হয়ে। গেছে। মানেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না ত্রিলোচনের। জীবিতাবস্থাতেই ছেলের বুক থেকে উপড়ে নেওয়া হয়েছে তার হৃদয়টি!
মাথাটা সোজা করে সেই খর্বকায় যবন রাজপুরুষটির দিকে তাকালেন ত্রিলোচন। তখনও উদ্ধত ব্যঙ্গের হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে ত্রিলোচনের দিকে তাকিয়ে আছে সেই মূর্তিমান পাপ।
বিড়বিড় করতে করতে হঠাৎ করে থেমে, চোখটা একবারমাত্র বুজেই ধক করে খুললেন ত্রিলোচন, আর সেই অভিজাত যবন, মনসেইনর রেভারেন্ডো, গোঁয়ার ভাইকার জেনারেল, শয়তানশ্রেষ্ঠ মিগুয়েল ভাঁজ যেন একটা শক্ত শীতল পাথরে ধাক্কা খেয়ে থেমে যান।
চোখ কোথায়? এ তো দু খানা জ্বলন্ত কয়লার টুকরো জ্বলছে এই পুরোহিতের অক্ষিকোটরে! সেই চোখের দিকে তাকানো যায় না, এতই ভয়ানক সেই অশুভ আগুনে দৃষ্টি। তার সঙ্গেই এই ব্রাহ্মণের সমস্ত দেহ জুড়ে শুরু হয় এক সূক্ষ্ম কম্পন, যেটা অভিজ্ঞ খ্রিস্টান ধর্মকর্তার চোখ এড়ায় না।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে একটা অপার্থিব গোঁ গোঁ আওয়াজের সঙ্গে হঠাৎ করে তাদের ঘিরে, শুধু তাদেরই ঘিরে মহাসর্পের মতন মাথা তুলে দাঁড়ায় একটা ঘূর্ণিঝড়! মিগুয়েল দেখছিলেন যে পাঁচশো গজ দূরে মাঠের ওইপাশের গাছগুলোর একটি পাতাও নড়ছে না। কিন্তু এদিকে যেন এক সর্বগ্রাসী মহাসর্বনাশী ঝড় তার বিষধর কালফণা তুলেছে দংশন করবে বলে। এরই সঙ্গে এক ভয়াল অন্ধকারে ছেয়ে গেল চারিদিক, কর্কশ আওয়াজ করে কতগুলো শকুন আর কাক উড়তে থাকে সবার মাথার ওপরে।অনির্দেশ্য নিয়তির মতন ওই ক্ষুদ্র ভূমিখণ্ডটি জুড়ে ঘনিয়ে আসে ঘনকৃষ্ণ মেঘরাজি, অকস্মাৎ কড়কড়াৎ শব্দে বিকটভাবে ফেটে পড়ে একটা বাজ।
কী হচ্ছেটা কী? ভয়মিশ্রিত একটা ফাঁকা আতঙ্ক বুকে চেপে বসে মিগুয়েল ভাজের। তিনি একজন ইওরোপশ্রেষ্ঠ এক্সরসিস্ট, অতিপ্রাকৃত ঘটনার লক্ষণগুলি তার থেকে ভালো চেনে এমন লোক ইওরোপে কমই আছে। কিন্তু তারও মেরুদণ্ড বেয়ে একটা ভয়ের হিমশীতল স্রোত নেমে যায়। এর প্রতিকার তার ক্ষমতার পক্ষে অসাধ্য।
বিড়বিড় করতে করতে তিনদিকে তিনবার থুতু ছিটিয়ে দেন ত্রিলোচন। এবার শব্দগুলো আরও স্পষ্ট ও উচ্চকিত হয়, যদিও অপার্থিব সুরেলা উচ্চারণে গাওয়া সেই অর্থহীন হৃং ক্লিং ফট স্বাহা সমন্বিত শব্দসমষ্টি কারোরই বোধগম্য হয় না।
প্রবল আতঙ্কে ভীত হয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন মিগুয়েল ভাজ, পুট দেম টু ফায়ার, ক্যইক। তৎক্ষণাৎ ঝপাঝপ করে তিনটি কাঠের তূপে জ্বলন্ত মশাল এসে পড়ে বেশ। কয়েকটা। ইতিমধ্যে পাগলের মতন মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে থুতু ফেলতে ফেলতে দুর্বোধ্য মন্ত্রোচ্চারণ করতে শুরু করেছেন ত্রিলোচন, সেই অনৈসর্গিক পাগলামির সুরে। বিদেশীয় সৈনিকদের মুখের রেখায় ভয়ের ছায়া পড়ে। এদেশীয় প্রাজ্ঞরা জানেন এ কোন অশনিসম্পাতের চিহ্ন, তারা ততক্ষণে সাষ্টাঙ্গে শুয়ে পড়েছেন বেতালমন্দিরের দিকে মুখ করে। বেসামাল হাওয়ায় টুপি সামলে রাখা দায় হয় দুই যবন রাজপুরুষেরই।