মনটা খারাপ হয়ে গেল তার। কবে যে ধর্মের বিষচক্র থেকে এই সরল দরিদ্র মানুষগুলির মুক্তি ঘটবে!
এমন সময় একজন রেঞ্জার্স দৌড়ে আসে তার কাছে, মাথা ঝুঁকিয়ে তার কানের কাছে ফিসফিস করে, আর্জেন্ট কল ফ্রম ল্যামেগা কমান্ডার, ফর ইউ।
একটু ভাবিতই হয়ে পড়েন মার্টিনেজ। আবার কোথাও কোনো জঙ্গি হামলা নাকি? ভেবেই শরীরটাকে শক্ত করে নেন তিনি, হলে হবে, কমান্ডার ডাকলে যেতে হবে বই কী! ডিউটি ইজ ডিউটি।
লোরান সিস্টেমের সিকিওরড চ্যানেলে ভিডিও স্ক্রিন অন হতেই সামনে সিটিই-র সর্বাধিনায়কের চৌকো খুনি মুখটা ভেসে ওঠে, টুয়েন্টি নাইন ল্যামড়া কাঁপা, এই মুহূর্তে একটা কমব্যাট হেলিকপ্টার নিয়ে কাবুল চলে আসুন কর্নেল। সেখানে আপনার জন্যে সুপারসোনিক আর্মি জেট তৈরিই আছে। ইউ নিড টু রিচ লিসবন বাই নেক্সট টেন আওয়ার্স।
অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে ওঠে মার্টিনেজের, ফিফটিথ্রি আল্ফা হ্যাশ, এনিথিং রং চিফ? এনিথিং সিরিয়াস দেয়ার?
চিফের ভাবলেশহীন মুখটা কি একটু অপ্রস্তুত দেখায় ক্ষণমুহূর্তের জন্যে? সামান্য গলা নামিয়ে বলেন, তিয়াগো ইজ সিরিয়াসলি ইল মার্টি। ডক্টর্স আর ফাইটিং আ রিয়্যাল টাফ ব্যাটল। কাম শার্প অ্যান্ড মিট তিয়াগো। হি ইজ লুকিং ফর ইউ ফ্রানটিক্যালি।
মার্টিনেজের সামনে পুরো দুনিয়াটা অন্ধকার হয়ে এল।
.
১৫৬০। অগাস্ট। গোয়া।
মন্দিরের চাতালের ওপর দুই যবন, তাদের সাজপোশাক দেখলে বোঝাই যায় যে তারা যথেষ্ট উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী। একজন অপেক্ষাকৃত দীর্ঘকায়, আরেকজন খর্ব। যদিও এই খর্বকায় ব্যক্তিটিই যে প্রধান সে নিয়ে সন্দেহ নেই। লোকটির দাঁড়ানোর মধ্যেও এক কর্তৃত্বব্যঞ্জক দৃঢ়তা আছে, যা বাকি লোকগুলির মধ্যে নেই।
কথাটা এসেছে ওই খর্বকায় মানুষটির গলা থেকেই, উদ্ধত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি, ডান হাত সামনে তোলা, আর সেই হাতেই ধরা সেই মহাবেতালশক্তিখণ্ডটি।
এত দুঃখ, কষ্ট, নির্যাতন, আসন্ন মৃত্যুর করাল ছায়া; তার মধ্যেও একটা মহাভয়ের শিরশিরে হিমেল স্রোত তার অন্তরাত্মাকে কাঁপিয়ে দিল।
আমোনার মহাবেতাল মন্দিরের পুরোহিতরা পুরুষানুক্রমে পুরোহিত পদে অধিষ্ঠিত হন না। তারা নিজেদের উত্তরাধিকারী খুঁজে নেন। শ্রদ্ধায়, নিষ্ঠায়, প্রতিভায়, নিয়মানুবর্তিতায় এবং সর্বোপরি মন্ত্রগুপ্তিতে সিদ্ধ– এমন ব্রাহ্মণ যুবককেই। উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করা হয়।
তার কারণ একটিই, প্রলয়ঙ্করী শক্তির উৎস এই আধারটিকে রক্ষা করা এবং সর্বসাধারণের নজর থেকে লুকিয়ে রাখা।
ত্রিলোচনের গুরু এবং পূর্ববর্তী পুরোহিত আচার্যশ্রেষ্ঠ প্রথমেশ যেদিন অভিষেক। করেন ত্রিলোচনের, সেদিনই এই শক্তিপীঠটি তার হাতে অর্পণ করেছিলেন। দেখিয়ে। দিয়েছিলেন গুপ্ত প্রকোষ্ঠটি, বুঝিয়ে দিয়েছিলেন সেটি খোলার কলাকৌশল। নইলে খালি চোখে দেখে ওই গুপ্তপ্রকোষ্ঠ আবিষ্কার করা বা সেটি খুলতে পারা স্বয়ং ঈশ্বরের। পক্ষেও অসম্ভব।
সেইদিনই ধীরে ধীরে এর মাহাত্ম ত্রিলোচনের সামনে উন্মোচন করেছিলেন প্রথমেশ।
সৃষ্টির আদিতে নাকি পাতাল থেকে উঠে এসেছিল এই শক্তিপিণ্ডটি। বলা হয়। একাদশ রুদ্রের তেজ আর মহাকালের ক্রোধ একত্রিত হয়ে এই শক্তিখণ্ডটির উদ্ভব। যে বস্তুতে এই আধারটি নির্মিত তা পার্থিব কোনো উপাদান নয়, শত সহস্র নীহারিকাপুঞ্জের ওপারের কোনো অলৌকিক অপার্থিব মায়ারাজ্যের উপাদান। সপ্তসমুদ্রের প্রচণ্ডমূর্তি, বা লক্ষকোটি ঝঞ্জাবর্ত এই শক্তিখণ্ডটির ক্ষমতার সামনে শিশুতুল্য। পাতালের শতসহস্র উগ্রতেজা অগ্নিভুক রাক্ষসের চণ্ডরোষ আর মেরুপ্রদেশের অযুত অর্বুদ মহাবলশালী তুষারদৈত্যদের সম্মিলিত তেজ দিয়ে এই মহাবেতালপীঠটির মজ্জা তৈরি। আর স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেবের ত্রিনয়নের আগুনের শোধন।
অশুভ শক্তির হাতে পড়লে এই শক্তি মুহূর্তে প্রলয় ঘটাতে পারে, লন্ডভন্ড করে দিতে পারে এই জগৎ ও সৃষ্টি। মহাবেতাল ছাড়া আর কেউ এই শক্তিখণ্ডটির ধারণের উপযুক্ত নয়, তাই এই দিয়েই মহাবেতালের হৃদয় গড়েছেন দেবাদিদেব, আর দিয়েছেন অমিত প্রতাপের অধিকার।এই মহাবেতাল তাই মহাশক্তিধর, মহাপ্রলয়ঙ্কর। মৃত্যুভয়ের অতীত, ভূতপ্রেতাদির একচ্ছত্র অধীশ্বর। স্বয়ং যম এঁর সামনে প্রণত থাকেন…।
কী রে কালো জন্তু, চিনতে পারছিস এটা? বিদ্রুপের সুরে বলে ওঠা কথাটা শুনে হুশে ফেরেন ত্রিলোচন। আর তীব্র ক্রোধে এই প্রথম কুবাক্য উচ্চারণ করেন তিনি, আরে মূর্খ, যেখানকার জিনিস সেখানে রেখে দে। অপবিত্র পশুর দল, কী জিনিস নিয়ে ছেলেখেলা করছিস সেটা বোঝা তোদের পশুবুদ্ধির অগম্য। যদি নিজেদের সর্বনাশ না চাস, এখুনি ফিরিয়ে দে ওটা।
চোয়ালটা শক্ত হয়ে ওঠে সেই যবন রাজপুরুষটির, লাল চোখ মেলে কিছুক্ষণ। তাকিয়ে থাকেন ত্রিলোচনের দিকে। তারপর হিসহিস করে ওঠেন, ব্রিং হিজসন অ্যান্ড। ওয়াইফ। পুট দেম টু ফায়ার, বাই প্যাপাল অর্ডার।
এতক্ষণ খেয়াল করেননি ত্রিলোচন, ধীরে ধীরে তার দুইপাশে আরও দুটি হাতে টানা গাড়ি এসে থামে। সেখানেও গাড়ির পাটাতনে গাঁথা মোটা খুঁটির সঙ্গে বাঁধা দুটি মানুষ। তাদের দেহের অর্ধাংশ ইতিমধ্যেই শুকনো আসান কাঠে ঢাকা।