এইবার দলের পান্ডা আর অন্য ক্লাসরুমে পাহারা দেওয়া র শাগরেদের নজর মা আদকে চাপা গলায় আগে তারা সঙ্গীদের নাম ধরে ডাকাডাকি করল খানিকক্ষণ । তারপর তাদের সাড়া না পেয়ে ব্যর্থতার আক্রোশে দুজনেই আগে কালাশনিকভ বার করে বাইরের দিকে এলোপাথাড়ি বন্দুক চালিয়ে দিল পাঁচ মিনিটের জন্যে। স্কুলের সামনে জড়ো হওয়া জনগণ সঙ্গে সঙ্গে আশ্রয় নিল মিলিটারি ব্যারিকেডের পেছনে।
তারপর কিছুক্ষণের ভয়ার্ত নৈঃশব্দ।
এইবার দুজনে নিচু হয়ে গুঁড়ি মেরে বাইরে আসে, দুজনেরই হাতে দুই শিশুর ভয়ার্ত শরীর, তাদের গলায় ধরা ছুরি! টেনশনের ছাপ সেই দুই মূর্তিমান শয়তানের সর্বাঙ্গে।
বাঁকা হাসলেন মার্টিনেজ, এতই যাদের মৃত্যুভয়, তারা নাকি শাহাদত বরণ করে স্বর্গে যাওয়ার জন্যে বড়ই উতলা।
নেভিগেশনে ধীরে আদেশ দিলেন তিনি, ফিফটিথ্রি আল্কা হ্যাশ, কম্যান্ড টু টুয়েন্টি ট ডেল্টা হ্যাশ, এনগেজ হেলবয় অ্যাট ইওর এন্ড, টেক নিয়ারেস্ট টার্গেট ডাউন।
আদ্রিয়ানো ধীরে পেছনে সরে গেলে তার জায়গা নিল গুস্তাভো, এই ইউনিটের হেলবয়। তিরিশ ফুট দূর থেকে যে কোনও সাইজের ছুরি বা ব্লো পাইপ দিয়ে শত্রুকে শায়েস্তা করতে গুস্তাভো এক্সপার্ট, প্রতিটি প্ল্যাটুনে একটি করেই হেলবয় থাকে। এদের ভুলচুক হয় না একেবারেই, সে টার্গেট স্থির হোক বা চলমান। আর নিক্ষিপ্ত বস্তুটি হৃৎপিণ্ড বা কণ্ঠনালী বা অন্য প্রাণঘাতী স্থান ছাড়া অন্য কোথাও বেঁধে না।
গুস্তাভো পেছনে সামান্য মাথা হেলিয়ে কী একটা বলল, সঙ্গে সঙ্গে আদ্রিয়ানো ক্রিকেট মাঠের উইকেট কিপারের মতো হাতের চেটো দুটিকে সামনে সামান্য পেতে বসল।
এরপর যেটা ঘটল সেটা শুধু ম্যাজিক। গুস্তাভো নিজের জায়গায় দাঁড়িয়েই দুবার জগিং করার ভঙ্গিতে অল্প লাফিয়ে তৃতীয়বারে একটু জোরে লাফায়, আর সঙ্গে সঙ্গে আদ্রিয়ানো গুস্তাভোর গোড়ালিদুটো আলতো করে ধরে সামনের দিকে শুধু উড়িয়ে দেয়, যেভাবে শৌখিন পুরুষ উড়িয়ে দেয় পোষা লক্কা পায়রা।
যেদিকে মার্টিনেজ ছিলেন তার উলটোদিকের কালাশ সন্ত্রাসবাদীটির হঠাৎই তাক লেগে যায় তার চোখের সামনে এক আজব দৃশ্য দেখে। যেন হঠাৎই, শূন্য থেকে তার চোখের সামনে চাকার মতন ঘুরতে ঘুরতে উড়ে আসে এক মানুষপাখি, তার শরীর জলপাই রঙের, মাথাটা বিলকুল কালো। অবাক হওয়া সরিয়ে সেই মানুষপাখির দিকে কালাশনিকভ তাক করার আগেই একটি গ্লকা বি ওয়ান ছুরি তার কণ্ঠনালীতে আমূল বিধে যায়। অবাক হয়ে খানিকক্ষণ সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে সেই সন্ত্রাসী যোদ্ধা, কিন্তু বেশিক্ষণ সময় পায় না, পর পর দুটো ছোটো ছুরি তার দুটো চোখের মণিতে এসে বিঁধে তাকে অন্ধ করে দেয়, ফিনকি দিয়ে রক্ত ছড়িয়ে পড়ে বারান্দায়। বিশাল শরীরটা যেন খানিকটা অবাক হয়েই বারান্দায় ধপ করে পড়ে এবং কাটা পাঁঠার মতন ছটফট করতে থাকে।
পুরো ঘটনাটা ঘটতে লাগে ঠিক একচল্লিশ সেকেন্ড!
এই প্রথম শব্দ হয় পুরো অপারেশনে, মৃতপ্রায় সন্ত্রাসবাদীটির হাতে ধরা শিশুটি অত রক্ত দেখে আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে এবং ঘটনার অভিঘাতে অজ্ঞান হয়ে যায়। দলের নেতাটি এবার ক্ষিপ্র হায়েনার মতন পিছনে ফিরে দেখে তার সঙ্গীর ছটফটানি, আর গলা থেকে ভলকে ভলকে বেরিয়ে আসা রক্ত। তখনই সে মেজাজ হারিয়ে চিৎকার করে গালি দিয়ে ওঠে। তার সামনে তখন তার সঙ্গীর দেহ ছাড়াও এক অজ্ঞান শিশু, আর বারান্দার শেষে দাঁড়ানো খাটো চেহারার এক কম্যান্ডো শরীর, ইতিমধ্যেই যার দুহাতে উঠে এসেছে দুটি হ্যান্ডগান। সে দ্রুত তার হাতে ধরা শিশুটিকে কাছে টেনে আনে ঢাল হিসাবে, আর তার সঙ্গেই চেষ্টা করে তার কালাশনিকভ তলে এই কাফেরের বাচ্চাটাকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়ার। কিন্তু তার আগেই তিন তিনটি বুলেট পেছন থেকে তার মাথা ছুঁড়ে দেয়, গুলিগুলো তার মাথা ফুটো করে মেঝেতে পড়ে ঠনঠনান আওয়াজ তোলে।
অবিশ্বাস্য মৃত্যুর অভিশাপ চোখে নিয়ে লোকটা সামনে দুম করে পড়ে যায় মেঝের ওপর।পেছনে দাঁড়ানো সিগ সয়্যারের অ্যাসল্ট রাইফেলটা নামিয়ে রাখেন মার্টিনেজ। তারপর তার চোখের ইশারায় গুস্তাভো আর ক্লদিও দ্রুত গিয়ে দুটো ক্লাসরুমে ঢুকে শিশুদের দায়িত্ব নেয়। মার্টিনেজ বাকি টিমকে আদেশ দেন বিল্ডিঙের প্রতিটি কোনা খুঁজে দেখার জন্যে। এরপর নেভিগেশনে সেন্ট্রাল কম্যান্ডকে বলেন সোয়ামবটসটিকে তার হাতের কাছে এনে দেওয়ার জন্যে। সেটিকে তালুবন্দি করে শান্তস্বরে খবর দেন, অল টার্গেটস লিকুইডেটেড। অল কিডস আর সেফ, নো ক্যাজুয়ালটি, নো মেজর ইনজুরি। এনটায়ার পেরিমিটার বিইং স্যানিটাইজড।
ওপার থেকে একটা ভারী গলা ভেসে আসে, গুড জব কমান্ডার, ওয়েল। ডান।
.
রাতে পার্টি হচ্ছিল ক্যাম্পে, সবার সঙ্গে মিশে আনন্দ উপভোগ করছিলেন মার্টিনেজ। জেরেনিমো চমৎকার মিমিক্রি করে। হাতে একটা ভদকার পেগ নিয়ে তাই দেখে হেসে কুটোপাটি হচ্ছিলেন তিনি।
যেহেতু রেঞ্জার্সদের প্রকাশ্যে মুখ দেখানো নিষিদ্ধ, তাই তাদের ক্যামেরার সামনে আনা হয়নি। দ্রুত একটি টয়োটার এসইউভিতে তুলে ক্যাম্পের দিকে রওয়ানা করে দেওয়া হয়।
তবু মার্টিনেজের মনে আছে তাদের গাড়ি ঘিরে ধরে আফগান বাবা মায়েদের আকুল কান্না, গাড়ির বনেটে আর জানালায় পাগলের মতন চুমু খাওয়া। দরিদ্র আফগান মায়ের কৃতজ্ঞতার অশ্রুর দাগ বোধহয় সেই গাড়ির বনেটে এখনও খুঁজলে পাওয়া যাবে। আসার সময় সাইড ভিউ মিররে দেখছিলেন মার্টিনেজ, তাঁদের গাড়ির টায়ারের দাগের ওপর। হাঁটু গেড়ে বসে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়া মানুষের আল্লাহর কাছে শুক্রিয়া আদাহ করা।মার্টিনেজদের মঙ্গলপ্রার্থনায় ঊর্ধ্বাকাশে উখিত সেই প্রার্থনার হাতগুলিকে ভোরের সূর্যমুখীর মতই পবিত্র মনে হয়েছিল মার্টিনেজের।