বাঁদিকে এটা কার শরীর? কে ও? যদিও খুব দ্রুতই উত্তর পেয়ে গেলেন তিনি। পুড়ে কাঠ হয়ে যাওয়া শরীরের নীচে বোবা দৃষ্টি নিয়ে বসে আছে এক উন্মাদিনী, তাকে দেখামাত্র বুঝলেন ত্রিলোচন, এ পুড়ে যাওয়া শরীর কার!
বিরোচন তাম্বে। তার একনিষ্ঠ সেবকদের মধ্যে একজন।
পরের কাষ্ঠদণ্ডটি, চিনতে কষ্ট হল না তার, এই চত্বরে ওই পাহাড়ের মতন বিশাল শরীর আর একজনেরই হতে পারে, প্রভঞ্জন মহাজন। দুর্ধর্ষ এই মারাঠি বীর ফৌজে ইস্তফা দিয়ে এসে চাষাবাদে মন দিয়েছিল, আর ত্রিলোচন গ্রামান্তরে গেলে প্রভঞ্জন হত তার দেহরক্ষী।একবার এক বন্য নেকড়েকে স্রেফ লেজ ধরে আছড়ে আছড়ে আর গলা। টিপে মেরেছিল সে। তাকে এরা ধরতে পারল কী করে?
মৃতদেহটা কাছে আসতেই বুঝতে পারলেন তিনি, ওই আধপোড়া বিশাল শরীরে অজস্র গভীর ক্ষত। মানে অনেকে ঘিরে ধরে বল্লম বা তলোয়ার দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে। মেরেছে প্রভঞ্জনকে।
এই প্রথম দুঃখ হল ত্রিলোচনের, এই প্রথম কোনো কষ্ট অনুভব করলেন তিনি। গলার কাছটা একদলা ব্যথায় মুচড়ে উঠল তার। শুধুমাত্র তার জন্য না জানি আর কত নিরপরাধের ঘর আজ শ্মশান হয়ে গেছে, কত অভাগীর সুখের সংসার পুড়ে ছাই হয়ে গেছে এই নিষ্ঠুর যবনের অত্যাচারে। ঠোঁটদুটো কেঁপে উঠল তার তিরতির করে। এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়তে চাইল বসে যাওয়া চোখের কোটর থেকে।
আর ঠিক তখুনি পিছন গাড়ির ওপরে উঠে এল তিনজন এ দেশীয় সেপাই। পাটাতনের মধ্যে যে মোটা খুঁটিটার সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছিল ত্রিলোচনকে, তার আশেপাশে গাদাগাদা শুকনো কাঠ এনে জড়ো করতে লাগল। শেষ হলে এইবার তিনজনে মিলে তাকে বাহুমূল ধরে হ্যাঁচকা টানে দাঁড় করিয়ে দিয়ে সেই মোটা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দিল, লোহার বেড়ি দিয়ে। এর মানে বুঝতে বেশি কষ্ট হল না ত্রিলোচনের, যেসব হতভাগ্যের পোড়া লাশ এখনও বিভিন্ন শ্মশানকাষ্ঠে ঝুলছে তাদেরই পরিণতি পেতে চলেছেন তিনি।
তারপর গাড়িটা এগিয়ে চলল বেতালমন্দিরের দিকে।
চোখটা একবার বুজলেন তিনি। ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করতে লাগলেন বিড়বিড় করে, প্রভুম প্রাণনাথম বিভুম বিশ্বনাথম জগন্নাথ নাথম সদানন্দ ভাজম, ভবদ্ভব্য ভূতেশ্বরম ভূতনাথম… আচ্ছা খুব কি ব্যথা লাগবে পোড়ার সময়? চামড়াগুলো কি গলে গলে পড়ে যাবে? নিজেকে দুচোখ মেলে দেখতে হবে জ্বলছে নিজের ত্বক, মাংস আর হাড়? নাকি তার আগেই মরে যাবেন উনি? কত তাড়াতাড়ি মরে যেতে পারে একটা মানুষ? যতই ভাবতে লাগলেন ততই যেন মনে হতে লাগল যে সারা দেহে মনে আর কোনো সাড় নেই।– তবুও একটা চিনচিনে স্বস্তির ভাব বুকের মধ্যে তবুও খেলা করে যাচ্ছিল তার।
যাক, ছেলেটা আর বউটা অন্তত রয়ে গেল, ওরা বেঁচে থাকুক লুকিয়ে। কোথাও যেন। একটা স্বস্তির শ্বাস তার উগ্রতপ্ত স্নায়ুগুলোকে সামান্য শান্তি দিল। আর একই সঙ্গে একটা কান্নার দলা যেন পাকিয়ে উঠতে লাগল ত্রিলোচনের গলার কাছটায়।এই ছেলে ত্রিলোচনের প্রাণ, বুকের পাঁজর, সাত রাজার ধন এক মানিক। বুড়ো বয়সের ছেলে, বেশিক্ষণ তাকে না দেখে থাকতে পারেন না ত্রিলোচন। আর আজ চলে যাওয়ার আগে তাকে একটিবারের মতন দেখতে পাবেন না?
বন্ধ চোখ থেকে হু হু করে জল পড়তে লাগল ত্রিলোচনের। আর ঠিক সেই সময়েই গাড়িটা থেমে যায় এবং একটি ভারী কণ্ঠ বলে ওঠে, কী রে শয়তান হিন্দু, কোথায় পালাচ্ছিলি এটা নিয়ে?
চমকে চোখ খোলেন ত্রিলোচন। দেখেন যে মন্দিরের প্রায় সামনে এসে গেছে তার গাড়ি। সঙ্গে সঙ্গে গরুটাকে খুলে নিয়ে যায় কেউ। বাকি দেশীয় সেপাইরা আরও গাদা গাদা চেরাই করে রাখা কাঠ এনে দ্রুত গাড়ির মধ্যে ফেলতে থাকে, যাতে সেই স্তূপ ত্রিলোচনের বুকের সমান উচ্চতায় পৌঁছয়। যদিও এত কিছু খেয়াল করেন না। ত্রিলোচন, স্থির চোখে তাকিয়ে থাকেন সামনে।
.
২০১৬। জুলাই। আফগানিস্তান
গুঁড়ি মেরে মেরে পুরো বারান্দাটা পেরিয়ে এলেন মার্টিনেজ, পেছন পেছন বাকি পাঁচজন। স্পেশাল রাবারাইজড জুতোর সোল, হিংস্র শ্বাপদের থাবার মতোই নিঃশব্দ। মোড়টার কাছে এসে কঠিন নৈঃশব্দে বসল সবাই।
হাতের ভিজিকমে পরিস্থিতিটা একবার দেখে নিলেন মার্টিনেজ।
সেই দুজন প্রহরী এখনও কালাশনিকভ হাতে স্থির দাঁড়িয়ে। স্কুল বিল্ডিঙের সামনেটায় অর্ধবৃত্তাকারে কর্ডন করে রাখা হয়েছে বিশাল এলাকা। সেখানে পুলিশ ও মিলিটারি জিপ, উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তারা, দেশিবিদেশি টিভি চ্যানেলের ওবি ভ্যান, বেসামাল জনতায় জায়গাটা লোকারণ্য হয়ে আছে। থেকে থেকে মাইকে পোশতু ভাষায় আবেদন ভেসে আসছে স্থানীয় জিরগার বৃদ্ধ ধর্মীয় নেতাদের। কিন্তু তাতে কেউ কান দিলে তো।
তবে যেটা কানে সবার আগে ভেসে আসছে, সেটা হচ্ছে মাঝেমধ্যেই শিশুদের ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠার আওয়াজ আর তার প্রত্যুত্তরে ভারী গলার ধমক। আর দলের পাণ্ডাটির আফগান সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালাবার অতি উচ্চকিত উগ্রকণ্ঠটি।
এমন সময় কানের কাছে নেভিগেশনে আদ্রিয়ানোর গলা ভেসে আসে, টুয়েন্টি টু ডেল্টা হ্যাশ, অ্যাট দ্য ফ্রন্ট বেন্ড।
হিসহিস করেন মার্টিনেজ, ফিফটিথ্রি আল্ফা হ্যাশ, পুল আউট হেল অ্যাভেঞ্জার, নিউট্রালাইজ নিয়ারেস্ট টার্গেট বাই নেক্সট থার্টি সেকেন্ডস।