আহ, বড় কষ্ট গায়ে। একটু নড়তে গিয়ে কঁকিয়ে উঠলেন তিনি, আর তখনই খেয়াল করলেন যে তিনি নড়তে পারছেন না, একটা খুঁটির সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে তাকে।
মাথাটা কাজ করছিল না ওঁর, তবুও বহুকষ্টে চোখ তুলে চাইলেন, আর মূক অপমানে আর বিস্ময়ে যেন পাথর হয়ে গেলেন।
একটা গরুর গাড়িতে বসে আছেন উনি, গাড়ির মাঝখানে একটি দণ্ড দৃঢ়ভাবে পাটাতনের মধ্যে প্রোথিত। আর তার সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে ওঁকে। ধীরে ধীরে যে গ্রামপথ দিয়ে, যেসব সহস্র স্তব্ধ চোখের সামনে দিয়ে ওঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এই পথ, সেই গ্রাম, সেইসব স্তব্ধবাক চোখ, এসবই উনি আশৈশব চেনেন, বড় নিবিড় ভাবে চেনেন।
আমোনা। ওঁর ছেলেবেলার খেলার মাঠ, যৌবনের প্রেম, প্রৌঢ়ত্বের সাধনভূমি, বড় প্রেমের আমোনা গ্রামেই আনা হয়েছে ওঁকে। যে গ্রামে উনি সম্মানের সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থান করতেন, যেখানে ব্রাহ্মণরাও তার রৌদ্রলাঞ্ছিত ছায়ায় শ্রদ্ধায় পা ফেলতেন না, যেখানে গ্রামের পশুরাও তাকে দেখে ভালোবেসে মাথা নিচু করে গা ঘষতে এগিয়ে আসত, সেই আমোনা গ্রামেই তাকে আজ সাধারণ চোর-ডাকাতের মতন বেঁধে আনা হয়েছে, বেঁধে আনা হয়েছে যেভাবে বনের পশুকে সর্বসমক্ষে পিটিয়ে মারার জন্যে আনা হয়। অর্ধনগ্ন, রক্তাক্ত, সর্বাঙ্গ ধূলিধূসরিত এই ত্রিলোচন ক্ষেমকল্যাণীকে দেখতে হবে, এ কথা বোধহয় আমোনা গ্রাম নিজেও স্বপ্নে ভাবেনি।
কিন্তু আজ তা সত্যি, বড় উগ্র, নগ্ন, জান্তব সত্যি! সারা আমোনা গ্রামের লোক আজ বিস্ফারিত চোখে দেখছে যে মানুষটিকে তারা শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় প্রায় দেবতার সম্মান দিয়েছিল, আজ তাকে এই যবন পাপমূর্তিরা প্রায় উলঙ্গ করে বেঁধে নিয়ে আসছে, যেভাবে কার্তিকের কৃষ্ণাচতুদর্শীতে আমোনার বেতালমূর্তির সামনে বলির জন্যে টেনে। নিয়ে আসা হয় অনিচ্ছুক মোষ ও পাঠাদের! আজ সমস্ত আমোনা গ্রাম চোখে অনেক কান্না জমিয়ে, অনেকটা ভয় আর আতঙ্ক বুকে নিয়ে, এই যবন শাসকদের আদেশে সাক্ষী হতে এসেছে এক মহা রকর্মের।
রাস্তায় যেতে যেতেই একবার যেন গাড়িটা কার আদেশে থেমে দাঁড়াল, বহুকষ্টে চোখ খুললেন ত্রিলোচন। আর সেই চোখ বন্ধ হল না তার, বুকের মধ্যে সহস্র কাটা ফোঁটার যন্ত্রণা নিয়ে তিনি দেখতেই থাকলেন।
তার বাড়ি, তার আশৈশবের বাড়ির সামনে থামতে বলা হয়েছে সেই গোশকটটিকে। বাড়ি বলে বোধহয় ভুল বলা হল, বাড়ি বলে যাকে চিনতেন, গাড়ি থামানো হয়েছে। সেই ধ্বংসস্তূপটির সামনে।
চারিদিকে শুধু আসান গাছের মধ্যে বয়ে যাওয়া হাওয়ার শব্দ, গোরুর গলায় বাঁধা ঘণ্টির টুংটাং আওয়াজ আর কোনো কোনো মেয়েলি ফুঁপিয়ে ওঠা, এ ছাড়া এই বিশ্বচরাচরে যেন আর কোনো শব্দ নেই। রক্তক্ষরা চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকলেন। ত্রিলোচন ক্ষেমকল্যাণী, তাকিয়েই থাকলেন।
তার সেই বড় সাধের, বড় ভালোবাসার বাড়িটি আর জ্বলে পুড়ে ছাই। শুধুমাত্র বেড়াটা আর ইতিউতি পড়ে থাকা বড় চেনা কিছু আধপোড়া গৃহস্থালীর সামগ্রী ছড়িয়ে আছে। যে বারান্দায় শিশু বয়েসে গাছের ছায়ার নাচন দেখে খিলখিলিয়ে হেসেছেন ত্রিলোচন, তার চিহ্নমাত্র নেই। যে শয্যাগারে নববধূর মুখচুম্বন করে জীবন। ধন্য করেছিলেন তিনি, আজ সেই ঘর পোড়া বিধবার মতন দগদগে জ্বলনক্ষত নিয়ে পড়ে আছে। চারিপাশের সেই বাগান, যা তার বাবা সযত্নে তৈরি করেছিলেন, আজ সেখানেই শ্মশানের পোড়া অভিশাপের স্তব্ধতা!
শুধু স্তব্ধতা? শুধুই এই বোধের অতীত জাগতিক স্তব্ধতা? নাকি আরও কিছু নারকীয়তা মিশে ছিল সেই ক্ষণিকের সর্বনাশা দৃশ্যটির মধ্যে?
বোবা চোখ নিয়ে ত্রিলোচন ক্ষেমকল্যাণী দেখলেন যে সেই পোড়া ধ্বংসস্তূপের মাঝখানে দুদিকে দুটি মোটা দণ্ড প্রোথিত, প্রতিটি দণ্ড আসান গাছের গুঁড়ি কেটে তৈরি। আর সেই দুটি গুঁড়িতে সম্পূর্ণভাবে বাঁধা অবস্থায় লটকে আছে দুটি পোড়া মানবশরীর। আর আছে তাঁদের প্রায় বুক অবধি জড়ো করা এবং পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া কাঠের স্তূপ।
জীবন্ত দাহ করা হয়েছে ওঁদের!
কেউ বলে না দিলেও ত্রিলোচনের অস্তিত্ত্বের প্রতিটি কণা বলে দিচ্ছিল এই দুটি পোড়া শরীর কার!
ওঁর মা আর বাবার!
অজ্ঞানই হয়ে যাচ্ছিলেন তিনি, মনে হচ্ছিল যেন তাঁর হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছে এসে বোবা কান্নায় আটকে আছে, মনে হচ্ছিল যেন তার মস্তিষ্ক শতসহস্র টুকরোয় ভেঙে ঝোড়ো হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে কোনো কালো নিয়তির দিকে। তবে এর পরেও যেন এক দৈব ইশারায় তার সেই ঘোলাটে দৃষ্টি চারিয়ে যায় আরও সামনের দিকে।
তাঁর বাড়ির থেকে কয়েকশো গজ দূরেই সেই বেতালমন্দির। আজ সেই রাস্তার দুধারে কালো কালো ছায়া। না ছায়া নয়, চোখটা একবার বুজেই খুললেন ত্রিলোচন, আমোনা আর আশেপাশের সমস্ত গ্রাম ঝেটিয়ে গ্রামবাসীদের আনা হয়েছে যেন এক নিষ্ঠুর তামাশার সাক্ষী হতে। আর কিছু দূরে দূরে সেই মোটা আসান গাছের গুঁড়ি পোঁতা আছে কম করে ছয় থেকে সাতটি। আর প্রতিটির সঙ্গে লটকে আছে একটি করে হতভাগ্যের পোড়া মৃতদেহ!
কারা ওরা? তার নিয়তি আর কোন্ কোন্ হতভাগ্যের জীবনে নামিয়ে এনেছে কালরাত্রি?
কার একটা চাপা গলার আদেশ শোনা গেল, টুংটাং আওয়াজ করতে করতে এগিয়ে চলল গোরুর গাড়িটি। তার সঙ্গে মিশেছে সেই গাড়ির চাকার কাঁচকোচ আওয়াজ, আর জনতা ক্রমে বধির বিস্ময়ে সরে গিয়ে পথ করে দিচ্ছে সামনে, আর সেই নারকীয় দৃশ্য ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে ত্রিলোচনের চোখের সামনে।