সেই ক্ষুদ্র গুবরেপোকার আকারের যন্ত্রটি এপার থেকে ওপারে একবার পাড়ি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরো দৃশ্যটা বুঝতে পারলেন কর্নেল মার্টিনেজ ভাজ।
মাঝের দুটি ক্লাসরুমের মাঝখান থেকে একটি সিঁড়ি নেমে গেছে নীচের দিকে।
স্কুলের সমস্ত শিশুদের ওই মাঝের দুটি রুমেই পণবন্দি বানানো হয়েছে। দুটি রুমেই দুজন করে লিডার গাছের লোক, তাদের ওপরেই যে অপারেশনের ভার, বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তাদের মধ্যে একজনের সামনে অত্যাধুনিক স্যাটেলাইট ফোন। আফগান সরকারের সঙ্গে যাবতীয় দরাদরি সেই-ই করছে। সবার পরনে একটি বিশেষ ধরণের পোষাক, তাই দেখেই মার্টিনেজের মনে হল যে এর পেছনে আফগানিস্তানের একটি প্রতিবেশী দেশের ভূমিকা থাকা আশ্চর্যের কিছু না।
আফগানিস্তান প্রাচীন কাল থেকেই তাজিক, পাশতুন, ওয়াজিরি, হাজারা, উজবেক ইত্যাদি বেশ কিছু মধ্য এশীয় জনজাতির মিশ্রণস্থল। এদের মধ্যে গোষ্ঠীচেতনা এতই প্রবল যে একমাত্র ধর্ম বাদ দিয়ে যে যার দেশীয় সংস্কৃতি কঠোরভাবে মেনে চলে, একে যথাসাধ্য অন্যের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলে। যে পোশাক সাধারণ আফগানি পুরুষ সচরাচর। পরে তাকে বলে সালওয়ার কামিজ, কিন্তু তারও রকমফের আছে। সাধারণ আফগানি পরুষ যে সালওয়ার কামিজ পরে তাকে বলে খেট পার্তুগ। ওপরের অংশকে বলে খেট, নিচেরটাকে বলে পার্তুগ। পাশতুনরা পরে পেরহান আর পাগড়ি। কিন্তু এরা যেটা পরে আছে সেটা উত্তর আফগানিস্তান আর উত্তর পশ্চিম পাকিস্তানের এক অত্যন্ত ক্ষুদ্র জনজাতির পোশাক।
এই জনজাতিটির উৎস প্রাচীনতম হিন্দু ধর্ম থেকে, এদের অধিকাংশ ধর্মীয় বিশ্বাস এখনও প্রোটো ইন্দো ইরানীয় ধর্মানুযায়ী যার পরের অংশ হচ্ছে বৈদিক হিন্দুধর্ম। ধবধবে ফর্সা আর নীল চোখের মালিক এরা, অনেকের ধারণা এরাই আদিতম এরিয়ান বা আর্য। এদের গোষ্ঠীগত ধর্মকৃত্য দেখলে এরাই যে আদিতম হিন্দু সে বিষয়ে সন্দেহ থাকে না। এদের ওপরে ষাট ও সত্তরের দশকে ইসলামিক জঙ্গিরা রাষ্ট্রীয় মদতে অকথ্য সন্ত্রাস। চালিয়েছে, এমনকি এদের বাসস্থানকে কাফিরিস্থান বলতে দ্বিধা করেনি পাকিস্তানের। ধর্মান্ধ জনগণ। উগ্র ইসলামিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে এই বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এসে সদ্য এরা মুসলিম হয়েছে। তারপর যা হয়, নিজেকে সাচ্চা মুসলমান প্রমাণ করার তাগিদে, অত্যধিক ইমানি জোশে, এই কাণ্ড ঘটাতে নেমে পড়েছে তাদেরই একাংশ। সাধারণত উত্তর পাকিস্তানের খায়বার-পাশতুন এলাকার চিত্রাল অঞ্চলেই এরা থাকে, এদের এলাকার শতাব্দী প্রাচীন আরেকটি নাম আছে, নুরিস্তান। আপাতত এরাই উত্তর আফগানিস্তান আর উত্তর পশ্চিম পাকিস্তানে সন্ত্রাসের উগ্রতম মুখ হিসেবে উঠে আসছে। যে পোেষাক এরা পরে আছে, তাকে স্থানীয় ভাষায় বলে শোউক বা চোগা।
এর থেকেই প্রমাণিত যে এই সন্ত্রাসের পেছনে যে দেশের মদত থাকতে বাধ্য, তার নাম পাকিস্তান।
আর এই জনজাতির নাম হল কলাশ।
.
১৫৬০। অগাস্ট। গোয়া।
অতি কষ্টে চোখ খুলেই আবার বন্ধ করে ফেললেন ত্রিলোচন। সমস্ত শরীরে তীব্র বিষের যন্ত্রণা। চোখটা খুলতে গিয়েই বুঝেছেন যে বাঁদিকের চোখটা বিশ্রীভাবে ফুলে আছে। ঘাড়ের কাছটা টাটিয়ে আছে, বোধহয় পেছন থেকে বন্দুকের কুঁদো দিয়ে কেউ মেরেছিল। তবে সব কিছু ছাপিয়ে যেটা অসহনীয় হয়ে উঠছে সেটা হচ্ছে তেষ্টা। অসম্ভব তেষ্টায় বুক ফেটে যাচ্ছে ত্রিলোচনের। প্রচণ্ড মেরেছে ওরা। বিঘ্ননাশ বেঁচে থাকলে যে অসহনীয় অত্যাচার নেমে আসত তার ওপর, বিঘ্ননাশকে না পেয়ে তারই কিছুটা ত্রিলোচনের ওপর দিয়েই গেছে কাল রাত থেকে।
সারা গা যেন ব্যথার বিষে অসাড় হয়ে আছে। কানের পাশ থেকে গলা অবধি। একটা ক্ষীণ তরলের ধারা শুকিয়ে এসেছে। ত্রিলোচন জানেন যে ওটা রক্ত।
সারা গায়ে দগদগে কালশিটে, না দেখেই বুঝতে পারছেন ত্রিলোচন। চাবক দিয়ে ওরা নির্মমভাবে পিটিয়েছে, গায়ে থুতু দিয়েছে, অশ্লীলতম কুবাক্য উচ্চারণ করেছে ওঁর পরিবারের মহিলাদের নিয়ে। লজ্জায়, ভয়ে, আতঙ্কে, ঘৃণায় সিটিয়ে গেছিলেন ত্রিলোচন, শরীরের ওপর দিয়ে যে ঝড়টা বয়ে যাচ্ছে, তার থেকেও বেশি অভিভূত করে ফেলছিল অপমানটা। গায়ে হাত তোলা দূরের কথা, আজ অবধি বেতালসিদ্ধ শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত ত্রিলোচন ক্ষেমকল্যাণীর সামনে কেউ মাথা তুলে কথা অবধি বলত না, এতটাই সম্মানের অধিকারী ছিলেন তিনি। আর আজ!
হা ঈশ্বর, গতজন্মের কোন পাপে আজ শাস্তি পেতে হচ্ছে তাকে? তবে যেটা একবারে দিশেহারা করে দিয়েছিল ত্রিলোচনকে সেটা হচ্ছে মহাশক্তিখণ্ডটি হাতছাড়া হয়ে যাওয়া। তার কোমরের গেজেতে হাত দিয়ে খুব সহজেই ওটা হাতে পেয়ে যায় সৈন্যরা, আর ওইসময়েই, একমাত্র ওই সময়েই তীব্র রোষে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন তিনি, বলেছিলেন, আরে মূখের দল, হাত দিস না, একদম হাত দিস না ওতে, সর্বনাশ হবে যদি ওই মহাবস্তু অপবিত্র করেছিস তো, নিজের ভালো চাস তো… আর বলতে পারেননি তিনি, একটা থাপ্পড় আছড়ে পড়েছিল তার গালে। আর তারপরেই নেমে এল। হিংস্র আক্রমণ। যেন ক্ষুধার্ত নেকড়ের দল ঝাঁপিয়ে পড়ল অসহায় মানুষটির ওপর। চড়, থাপ্পড়, লাথির পর শুরু হল চাবুক আর লাঠি দিয়ে পেটানো, লোকে বোধহয় হিংস্র জন্তুকেও এমন প্রহার করে না। তারই মধ্যে কে একজন পেছন থেকে এসে বন্দুকের কুঁদো দিয়ে মাথার পেছনে সজোরে আঘাত করতেই জ্ঞান হারান ত্রিলোচন।