স্থির হয়ে বিস্ফারিত চোখে সেই শিশুটির দিকে তাকিয়ে রইলেন দুর্গাশঙ্কর, সারা শরীর কাঁপছে শুকনো বাঁশপাতার মতন, হাতে পায়ে বশ নেই, ঠোঁটের পাশ গড়িয়ে নামছে সাদা ফেনার মতন কষ, থরহর কাঁপছে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ পিশাচসিদ্ধ তান্ত্রিক দুর্গাশঙ্করের সমস্ত আত্মা, সমস্ত সত্ত্বা!
বাকিঠগিরা স্তব্ধ হয়ে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে দেখছিল তাদের নিষ্ঠুর নির্দয় ভয়ংকর, কিন্তু এই মুহূর্তে বেপথু বেএক্তিয়ার অচেনা ঠাকুরকে। একটি শিশুর লাশ দেখে ঠাকুর অত ব্যাকুল হয়ে পড়লেন কেন সেটা ওরা কেউই বুঝতে পারছিল না। ছুটনিয়া হাতজোড় করে নিবেদন করে গুসসা না করে ঠাকুর, একে তো জিন্দা রাখতেই চেয়েছিলাম, ঝুরকো মাহাতোকে বেচলে ভালো দাম পাওয়া যেত। তাই তাঁবুর বাইরেই বাবুনিয়া খে লাকরছিল একে নিয়ে, কী যে হল, ঠিক ঝিরণী দেবার সময়েই দৌড়ে এসে ঢুকল, তখন কি আর বাঁচিয়ে রাখা যায় ঠাকুর? আপনিই বলুন–
এসব কথার বিন্দুবিসর্গ দুর্গাশঙ্করের কানে ঢুকছিল না; থরথর দেহে, বিস্ফারিত চোখে তিনি চেয়েছিলেন সেই শিশুটির আতঙ্কিত চোখদুটির দিকে, কুঁকড়ে যাওয়া আঙুলগুলির দিকে, যন্ত্রণায় নীল হয়ে যাওয়া ঠোঁটদুটির দিকে…
তিরিশ বছর, তিরিশটা বছর অপেক্ষা করেছেন দুর্গাশঙ্কর। যে হারিয়ে যাওয়া মেয়েটিকে ফের ফিরে পাওয়ার জন্যে জীবনের সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়েছেন, নরকের দরজায় নিজের আত্মাকে বলি দিয়েছেন নিজের হাতে, আজ সেই মেয়ে ফের একটি লাশ হয়ে শুয়ে আছে দুর্গাশঙ্করের সামনে। হুবহু সেই মুখ, সেই চোখ, সেই কোকড়ানো চুল, সেই গোলমটোল শরীর। যাকে বুকে জড়িয়ে ধরলে দুর্গাশঙ্কর স্বর্গসুখ পেতেন, যার অভিমানে ফোলানো ঠোঁট দেখলে দুর্গাশঙ্করের বুকে শেল বিদ্ধ হত, একটা পুঁতির হারছড়া হাতে পেলে যার মুখের হাসি দেখে দুর্গাশঙ্কর নিজেকে ধন্য মনে করতেন, যে মেয়ে তিরিশ বছর আগেকার এক সর্বনাশা আগুনে সন্ধ্যায় দুর্গাশঙ্করের সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেছিল, ঠিক সেই মেয়েই যেন কোন এক অলঙ্ঘনীয় অলৌকিক শক্তির ইশারায় তান্ত্রিকশ্রেষ্ঠ ঠগি দুর্গাশঙ্কর পণ্ডিতের তিরিশ বছরের সাধনাকে এক লহমায় মাটিতে মিশিয়ে দেবে বলে মাটিতে শুয়ে আছে!
মুন্নিইইইইইইই, বেটি আমার, কোথায় গেলি তুই!–বলে একটা আর্তনাদ করে সেই শিশুটির লাশের ওপর আছড়ে পড়লেন দুর্গাশঙ্কর!
হতভম্ব ঠগিদের দল বুঝতেও পারল না যে তাদের ঘিরে ফেলেছে গোরা সিপাহিদের লালমুখো ফৌজ।
বুঝলেও অবশ্য কিছু করার ছিল না আর!
*********
গভীর রাতে যখন কোমরে দড়ি পরা দুর্গাশঙ্করকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন স্লিম্যান, তখনও দুর্গাশঙ্কর প্রলাপ বকে চলেছেন। রক্তজবার মতন লাল চোখ, শনের মতন উসকোখুসকো চুল উড়ছে হাওয়ায়। ইতিউতি চাইছেন, পাশে খোদাবক্সকে দেখেও চিনতে পারলেন না। মুখে শুধু, মুন্নি, মুন্নি মা আমার গোঙানি। থেকে থেকেই হাঁট ভেঙে পড়ে যাচ্ছেন, ফিরিঙ্গিয়া আর খোদাবক্স ধরে তুলে দিচ্ছে সেই অবশ থরোথরো। দেহ, ফের টানতে শুরু করছেন স্লিম্যান।
ব্রিটিশ আর দেশি সিপাইরা বাকি ঠগিদের মহড়া নিচ্ছে এখন। অবশ্য হতবাক সেই খুনিগুলোকে কজা করতে শিক্ষিত সৈন্যবাহিনীর বেশি দেরি হবার কথাও নয়। এখন। স্লিম্যানের দরকার খোদাবক্সের দেখে যাওয়া কুয়োটা, যাতে এভিডেন্স-সহ ওয়াটারটাইট কেস খাড়া করতে পারেন এই ডেমোনিক পণ্ডিতটির ওপর।
একে জায়গাটা বেশি দূর নয়, তার ওপর শুক্লপক্ষ চতুর্দশী, খুব দ্রুতই সেই প্রাচীন। কয়োটির কাছে পৌঁছে গেল এই ছোট দঙ্গলটি। তার ক্ষণিক পরেই খুব দ্রুত সেই কুঁয়োর ওপরের ডালপালা সরিয়ে সেই প্রাচীন গহুরটির মুখ উন্মোচন করে খোদাবক্স। আর ফিরিঙ্গিয়া।
ফের সেই বিষণ্ণ কটু মড়াপচা গন্ধ ধাক্কা মারে সবার নাকে, নাকে হাত চাপা দেয়। তিনজন, দুর্গাশঙ্কর ক্রমাগত বকতে থাকেন। কী মনে হতে বাঁ হাতে নাক চাপা দিয়ে ডানহাত দিয়ে দুর্গাশঙ্করের হাত চেপে ধরেন স্লিম্যান, সঙ্গে সঙ্গে শিউড়ে উঠে হাত ছেড়ে দেন…
প্রবল জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে দুর্গাশঙ্করের উত্তপ্ত গা, দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। যেন, ছোঁয়া অবধি যায় না।
ততক্ষণে একটা মশাল জ্বালিয়ে ফেলেছে ফিরিঙ্গিয়া, সেইটা হাতে নিয়ে কুয়োর। ওপরে তুলে ধরেন স্লিম্যান, পিছন থেকে উঁকি দেয় খোদাবক্স আর ফিরিঙ্গিয়া, এবং তিনজনেই শিউড়ে ওঠেন!
নীচে গাদাগাদি করে পড়ে আছে একগাদা লাশ।
বেশিরভাগই কঙ্কাল, সাদা হাড়গুলো হা হা করে হাসছে যেন।কিছু লাশ আধপচা, মাংস গলে খসে পড়ছে, চোখের গর্ত থেকে দলে দলে বেরিয়ে আসছে মাংসখেকো পোকার দল। একটি দুটি লাশ দেখলে বোঝা যায় যে তখনও পচন ধরেনি, সদ্য এখানে ফেলা হয়েছে।
একরাশ ঘৃণা আর বিস্ময় মিশিয়ে সেই অপ্রকৃতিস্থব্রাহ্মণের দিকে ফিরলেন স্লিম্যান, এইসব তোমার কাজ পণ্ডিত? এদের নিয়ে তুমি ব্ল্যাক ম্যাজিক করেছ?
জবাফুলের মতন লাল টকটকে চোখ মেলে চাইলেন দুর্গাশঙ্কর, সম্পূর্ণ ফাঁকা ঘোলাটে দৃষ্টি নিয়ে আশেপাশে কী যেন দেখলেন, তারপর ফিসফিস করে বললেন ওরা আমাকে ডাকছে।
কথাটা ভালো করে শুনতে পাননি স্লিম্যান, তাই ফের জিজ্ঞেস করেন কে ডাকছে পণ্ডিত?
ওরা আমাকে ডাকছে, তোমরা কেউ শুনতে পাচ্ছ না? ওরা সবাই মিলে আমাকে ডাকছে যে। পাতাল থেকেওরা উঠে আসতে চাইছে, শুনতে পাচ্ছ না তোমরা? ডাকছে। আমাকে, আমাকে যেতে হবে, ডাকছে ওরা, আমাকে যেতে হবে, যেতে হবে… বলতে বলতে দৌড়ে গিয়ে সেই কুয়োর মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে পড়লেন দুর্গাশঙ্কর পণ্ডিত!