হঠাৎ কেমন যেন মনে হল ওঁর, তাঁবুর ওইপারেও কতগুলি ছায়া যেন একবার। নড়েই স্থির হয়ে গেল না?
ঠিক দেখলেন? নাকি দৃষ্টিবিভ্রম?
মনটা বড় দুর্বল আর অশান্ত হয়ে হয়ে আছে সন্ধে থেকেই। বার বার চিত্তবিক্ষেপ হচ্ছে, না হলে দৃষ্টিসীমার মধ্যে কে কোথায় কী করছে সে কথা দুর্গাশঙ্কর মুহূর্তে বলে দিতে পারেন। মনঃসংযোগ না করলে চিত্তপটে কিছুই উদ্ভাসিত হয় না। আর আজ…
কিছুক্ষণ ভ্রূকুঞ্চন করে সেই দিকে তাকিয়ে রইলেন উনি। সব স্থির। নাঃ, বোধহয় রেকলান বা শিয়াল-টিয়াল হবে।
ক্ষণমুহূর্তের মধ্যে তাঁবু থেকে কে উঁচু গলায় চেঁচিয়ে উঠল, সাহেব খান, তামাকু লাও।
তাঁবুর ভিতরে আলোছায়ার মধ্যে কতগুলি প্রাণীর ছটফট দেখতে পাচ্ছিলেন দুর্গাশঙ্কর। প্রত্যেকের পিছন থেকে একজন করে ঠগি গলায় পরিয়ে দিয়েছে কালান্তক পেলহু। প্রতিটি শিকারের পা দুটো ধরে আছে একেকজন চুমিয়া, যাতে ছটফট না করতে পারে শিকার, শিকারের হাত দুটি ধরে আছে একেকজন চুমোসিয়া, যাতে হতভাগ্য মানুষটি বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ না গড়ে তুলতে পারে!এর সঙ্গে প্রধান ঘাতক যে পেলহুধারী ঠগি, ওদের ভাষায় ভুরকুত, সে হাঁটু দিয়ে ক্রমাগত শিরদাঁড়ায় চাপ দিতে থাকে, যাতে মেরুদণ্ড ভেঙ্গে মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়!
এসব মৃত্যুনাটিকা অনেক দেখেছেন দুর্গাশঙ্কর। এসব ওঁকে বিচলিত করে না আর অনেক আগে থেকেই।
শব পাওয়া নিয়ে কথা।
সাধনা শেষ করা নিয়ে কথা।
সেই চাঁদমুখটি আবার বুকের মধ্যে পিষতে পারার আনন্দ নিয়ে কথা ।
আজ পৃথিবী জানবে এক বাবা তার মৃত মেয়েকে ফিরে পাওয়ার জন্যে কী কী করতে পারে!
শুক্লা চতুর্দশীর চাঁদ মাথার ওপর প্রায়। অপার্থিব জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে বিশ্বচরাচর। সামনে ছায়ার মতন এক ছোটো তাঁবুতে অভিনীত হচ্ছে এক অসহায় মৃত্যুনাটিকার ইতিকথা।নির্বাক নিরাসক্ত দর্শক হয়ে দেখছেন দুর্গাশঙ্কর।দেখছে গাছে। আড়ালে লুকিয়ে থাকা আরও বেশ কয়েকজন মৃত্যুব্যবসায়ী ঠগিও। হাওয়াও বইছে।
একটুও, প্রতিটি গাছের পাতা স্থির। তাঁবু থেকে ভেসে আসা হাঁচোরপাঁচোরের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দও নেই।
এমন সময়ে দিগবিদিক সচকিত করে ভেসে এলো এক অপার্থিব আর্তনাদ, বাপু, কোথায় তুমি? আমার খুব কষ্ট হচ্ছে!
এক মুহূর্তের মধ্যে আতঙ্কে আর বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন দুর্গাশঙ্কর!
সেই গলা, সেই ডাক, সেই আকুতি, যেন ত্রিশ বছর আগেকার এক আগুনে পুড়ে-যাওয়া শাপগ্রস্ত সন্ধে থেকে উঠে এসে দুর্গাশঙ্করের বুকে দীর্ঘ ভল্লার মতই বিধে দিল!
মুন্নিইইইইই বলে উন্মত্ত পিশাচের মতন তাঁবুর দিকে ছুটে চললেন দুর্গাশঙ্কর।
ত্রিশ বছর আগে হেরে গেছিলেন। আজ নয়, আজ নয়, আজ কিছুতেই নয়, কিছুতেই নয়। এর জন্যেই, এর জন্যেই এত সব কিছু…
উন্মাদের মত ছুটে চললেন দুর্গাশঙ্কর।
*********
জঙ্গলের মধ্যে পঞ্চাশ জনের ব্রিটিশ আর্মি, দশজন দেশি সিপাই, ফিরিঙ্গিয়া আর। খোদাবক্সকে নিয়ে থাপ বা তাঁবুর কাছেই স্থির দাঁড়িয়েছিলেন স্লিম্যান।
শঙ্কা আর কর্তব্যের দোলাচলে দুলছিলেন স্লিম্যান। আজ যদি দুর্গাশঙ্কর ধরা পড়ে, ঠগিদের নির্মূল করাটা শুধু সময়ের অপেক্ষা। আর যদি না ধরা পড়ে?সত্যিই যদিঅকাল্ট পাওয়ার বলে কিছু থাকে? সৈনিক তিনি, নিজের জন্যে ভাবেন না। কিন্তু এমিলি।
একটু দূরেই টেন্টটা দেখা যাচ্ছে, বোঝাই যাচ্ছে যে হুল্লোড় চলছে খুবই। শরীরটা টানটান হয়ে উঠল স্লিম্যানের। শুনেছেন যে এটাই সেই সময়। যে কোন মুহূর্তে ঝিরণী উঠতে পারে। শিকারী বাঘের মতন তীক্ষ্ম স্নায়ু আর পেশী নিয়ে সতর্ক হলেন উনি। সুশিক্ষিত ব্রিটিশ সৈন্যদল নিঃস্পন্দ রইল। দেশি সিপাই, খোদাবক্স আর ফিরিঙ্গিয়াও এই স্তব্ধ জ্যোৎস্নার মাঝে অজানা আশঙ্কায় শ্বাস অবধি বন্ধ করে রইল। ( যেন এক আসন্ন মূর্তিমান অমঙ্গলের ছায়া চারিদিকে!
এমন সময়ে সেই স্তব্ধতা খানখান করে অমোঘ মৃত্যু পরোয়ানা নেমে এলো শিকারি। বাজের মতই, সাহেব খান, তামাকু লাও।
দৌড়েই যাচ্ছিলেন স্লিম্যান, পিছন থেকে খোদাবক্সের হাত টেনে ধরে। এখন নয়, মনে পড়ে যায় স্লিম্যানের, আজকে দুর্গাশঙ্কর ঝিরণী দেওয়ার পর ঢুকবেন। অতএব আরও খানিকক্ষণ ধৈর্য ধরা ছাড়া উপায় নেই। দাঁতে দাঁত চিপে চাঁদনি রাতের শিলুয়েটে তাঁবুর মধ্যেকার অসহায় মানুষগুলির ছটফটানি দেখছিলেন স্লিম্যান। দুরন্ত অসহায় ক্রোধেশপথ নেন স্লিম্যান,হয় দুর্গাশঙ্কর সহ পুরো দলকে ধরে কঠিনতম শাস্তি দেবেন, অথবা নিজেকেই নিজে গুলি করে মারবেন, দেখা যাক কে জেতে আজ, অকাল্ট হিউম্যানিটি অ্যান্ড জাস্টিস!
এমন সময় যেন করুণ নিয়তির মতই দিকবিদিক শিউড়ে দিয়ে ভেসে এল সেই আর্তনাদ, বাপু, কোথায় তুমি? আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
লাফিয়ে ওঠেন স্লিম্যান, একটা বাচ্চার গলা না? চাবুকের মতন আছড়ে দেন। নির্দেশটা কাম অ্যালং, তারপর ঝোঁপঝাড় ভেঙে দৌড়তে থাকেন তাঁবুর দিকে।
*********
তাঁবুর মধ্যে ঢুকেই দুর্গাশঙ্করের চোখ পড়ল মাটিতে রাখা লাশেদের স্তূপ এবং সেই লাশেদের মাঝে শোয়ানো একটি আট-দশ বছরের মেয়ের মৃত শরীরের ওপর।
সেই নিষ্পাপ শিশু যেন ভয়ে, আতঙ্কে কাঠ হয়ে যাওয়া দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। ওপরের দিকে, অব্যক্ত আকুতিতে যেন কাকে খুঁজছে, শেষ আশ্রয় হিসেবে। গলায় তখনও খয়েরি কালো রঙের খুনি রুমালটি জড়িয়ে, যেন শেষ বিকেলে দেখা সেই শঙ্খচুড়টির মতন!