*********
কাল থেকেই ব্যস্ত ছিলেন দুর্গাশঙ্কর। জন্মের শোধের শেষ সাধনা আজ। গত হাজার বছরেও এই পূজা করার সাহস কেউ করেনি, আগামীহাজার বছরেও কেউ করবেনা,স্থির নিশ্চিত উনি। গত তিরিশ বছর ধরে তিলতিল করে জীবনের সমস্ত স্বপ্ন, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, সম্বল একত্রিত করে আজকের দিনটির জন্যে প্রস্তুত হয়েছেন তিনি।ন্যায়-অন্যায় বোধ বিসর্জন দিয়েছেন, শাস্ত্ৰাজ্ঞা উপেক্ষা করেছেন অমিত তত্ত্বজ্ঞানের জোরে, দয়ামায়ার যাবতীয় বোধ পুড়িয়ে ফেলেছেন নিজেই। সমস্ত বাধাবিঘ্ন, অন্তরাত্মার নিষেধ দুপায়ে মাড়িয়ে এগিয়ে গেছেন অভীষ্ট সাধনের দিকে। আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।
তিরিশ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া একটি মুখ আবার দেখতে পাবেন বলে সর্বস্বপণ করে বিধাতাপুরুষের বিরুদ্ধে এই খেলায় নেমেছিলেন দুর্গাশঙ্কর। আজ সেই খেলার শেষ দান। দুনিয়াশুদ্ধ সবকিছু তুচ্ছজ্ঞান করে, নিজের অস্তিত্বের সব কিছু স্পর্ধাভরে বাজি রেখে জীবনের যে জুয়াখেলায় নেমেছিলেন দুর্গাশঙ্কর, আজ সেই বাজি জিতে নেবার দিন। অতুল তন্ত্রতেজে বলীয়ান হয়ে এই ক্রুর নির্দয়া প্রকৃতির বিরুদ্ধে শোধ তোলবার দিন।
আজ কোনো ভুলচুক বরদাস্ত করার প্রশ্নই ওঠে না। গত বেশ কয়েকবছর ধরে। জোগাড় করা দুষ্প্রাপ্যতম পুজোপকরণগুলি একত্রিত করেছেন আজ সকাল থেকে। সমস্ত কিছু সেই শ্মশানের পাশের কুঁড়েঘরটিতে গুছিয়ে রেখে, সমস্ত আয়োজন অনুপুঙ্খরূপে একবার দেখে নিয়ে ইষ্টস্মরণ করলেন উনি।
সব সাজাতে সাজাতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এল, এইবার বেরোতে যাবেন, এমন সময়ে শ্মশানের সামনের অঁড়িপথের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে গেলেন দুর্গাশঙ্কর।
একশোগজ দূরে বাঁদিক থেকে ডানদিকে রাস্তা পার হচ্ছে এক বিশালদেহী সাপ, যার গায়ের খয়েরি কালো আঁশে পড়ন্ত রৌদ্রের শেষ আলো বিচ্ছুরিত হয়ে এক মায়াবী বিভ্রম সৃষ্টি করেছে। একবার থমকে দাঁড়াল সেই মহাসর্প। মাথা উঁচু করে কালো চোখ দুটি দিয়ে স্থিরভাবে দুর্গাশঙ্করকে একবার দেখে নিয়ে দীর্ঘ চেরা লকলকে জিভটি বার দুয়েক বার করে তারপর মাথা নামিয়ে আবার ধীরেসুস্থে চলতে লাগল।
শঙ্খচুড়। বিষধর সাপেদের রাজা। রাজার মতই চলন বটে। কী আভিজাত্য, কী দার্চ, চেয়ে দেখবার মতন।
কিন্তু সে জন্যে জঙ্গলাকীর্ণ ভারতবর্ষ পায়ে হেঁটে চষে ফেলা দুর্গাশঙ্কর বিচলিত হলেন না। হলেন এই জন্যে যে তন্ত্রসাধনায় ব্রতী হবার আগে এটি একটি অত্যন্ত দুর্লক্ষণ। যদিও এসব ছোটোখাটো বাধা নিষ্প্রভাব করা ওঁর কাছে কিছুই না। তবুও মহাযজ্ঞের আগে মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল।
দ্রুত চলতে লাগলেন দুর্গাশঙ্কর। কিছু তন্ত্রাভ্যাসের ফলে অস্বাভাবিক দ্রুত চলতে পারেন তিনি, একটু দূর থেকে হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন কেউ উড়ে চলেছে। খবর পেয়েছেন যে এইবার থাপ বা তাঁবু কোথায় পড়েছে।
এমন সময়ে, তখন বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে, স্পষ্ট শুনতে পেলেন কাছেই কোনো গাছের ডালে ঘুঘু ডাকছে।
মুহূর্তের মধ্যে গতি শ্লথ হয়ে এল। তারপর ক্রমে ক্রমে থেমে গেলেন। রাত্রিবেলা ঘুঘুর ডাক শাস্ত্রোক্ত দুর্লক্ষণগুলির মধ্যে অন্যতম।
কী হচ্ছে এসব? আজই কেন? একশো সাতটি শবসাধনা সুসম্পন্ন করেছেন তিনি। ইতিমধ্যেই ওঁর তুল্য পিশাচসিদ্ধ তান্ত্রিক এ দেশে আর নেই। বাকি আর একটি, মাত্র একটি। জীবনের জুয়াখেলায় আজই তো শেষদানে সবকিছু একলপ্তে জিতে নেবার দিন। আর আজই এসব দুর্লক্ষণ কেন? আজই কেন?
মনকে শক্ত করেন উনি। এইসব ছোটোখাটো বিঘ্ন এড়াবার অজস্র উপায় উনি জানেন, এগুলি তন্ত্রসাধনার অতি নিম্নস্তরের শিক্ষা। কিন্তু তবুও, আজ এই শেষ বিজয়ের লগ্নে এইসব দুর্লক্ষণ ওঁর মনকে অজানিতেই দুর্বল করে দিচ্ছিল। আজই কেন? এতদিন তো নির্বিঘ্নেই সব কিছু সুসম্পন্ন হয়ে এসেছে। মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে গেল দুর্গাশঙ্করের।
থামলে চলবে না। লগ্ন বয়ে যায়। শনি মকরে থাকতে থাকতে সেরে ফেলতে হবে সব কিছু, মায় শবদেহটিকে সেই প্রাচীন কুয়োতে বিসর্জনের কাজটি অবধি।
আর যদি, ঈশ্বর না করুন, কোনো অলৌকিক প্রকরণে আজকের এই সাধনা শেষ। করতে পারেন দুর্গাশঙ্কর? তবে?
সেই পরিণতি ভাবতেও ঘাম ছুটে গেল ওঁর। শাস্ত্রানুসারে, যে শবসাধনার সংকল্প। করে তান্ত্রিক ব্রতী হন, সেই শবসাধনা সম্পূর্ণ না করলে তদবধি সাধিত শবেদের অতৃপ্ত আত্মারা ভয়ঙ্করতম শোধ নেয় তান্ত্রিকের ওপর! আর সেই প্রতিশোধ আটকাবার ক্ষমতা স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেবেরও নেই।
এই সব ভাবতে ভাবতে হাঁটার সময় খেয়াল করেননি দুর্গাশঙ্কর।একটু দূরে জঙ্গলে মধ্যে আলো দেখেশে এলেন।একদম কাছাকাছি এসে পড়েছেন। ছোট্ট বুটির মধ্যে আলো, হাসি গান ঠাট্টার দমক ভেসে আসছে। তাঁবুর বাইরেও কয়েকজন অন্ধকারে মিশে আছে। পিশাচসিদ্ধ দুর্গাশঙ্কর অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখতে পান, তাই দেখলেন যে এরা ওঁর নিজের দলেরই সদস্য।ঝিরণীর অপেক্ষা করছে। দু-একজন বনোয়ারিলালের ঘোড়াটার পরিচর্যা করছে।– দাঁড়িয়ে গেলেন উনি। ঝিরণীর একটু পরেই ঢুকবেন না হয়। এখন অচেনা মানুষ হুট করে ঢুকে পড়ে গোল বাঁধাবার কোনো মানেই হয় না।
দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন দুর্গাশঙ্কর, নিবাত নিষ্কম্প কৃষ্ণবর্ণ দীপশিখাঁটির মতন। স্থির, অচঞ্চল, একাগ্র, দৃঢ়সংকল্প। এই দীপশিখায় আলো নেই। শুধু স্বার্থসাধনের ত্রুর ঘনকৃষ্ণ আকাঙ্ক্ষাটি আছে!