একটু ইতস্তত করেন স্লিম্যান, যদি তোমার কথা সত্যি ধরে নিই ঠাকুর, যদি সত্যি দুর্গাশঙ্কর একজন কাউকে বাঁচিয়ে তোলে, তাতে কী অনর্থ হতে পারে?
কী বলছ সাহেব? এর মানে জানো তুমি? জন্মমৃত্যু হল প্রকৃতির বিধান। বিধাতাপুরুষেরও হাত নেই এর ওপর। এ নিয়ম উলটে দিলে প্রকৃতির রুদ্ররোষ আছড়ে। পড়বে পৃথিবীর ওপর। হাজার হাজার লোকের মৃত্যু হবে, খরা-বন্যা-মহামারীতে জনবসতি উজাড় হয়ে যাবে। নদীতে জলের বদলে রক্ত বইবে; ক্ষেতের ফসল আর গাছপালা শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে যাবে; পাতাল থেকে দলে দলে উঠে আসবে নরকের মূর্তিমান পাপ।বীরভোগ্যা বসুন্ধরা প্রেতভোগ্যা হবে। প্রকৃতিদেবীর ক্রোধ বড় ভয়ানক সাহেব, কারও রেহাই মিলবে না।
ভুরু কুঁচকে শুনছিলেন স্লিম্যান। এসব সুপারস্টিশানে ওঁর বিন্দুমাত্র আস্থা নেই। কিন্তু দুর্গাশঙ্করকে আটকানোটা সবচেয়ে জরুরি।এই আঘাত ঠগিরা সহ্য করতে পারবে না। এরা ক্ষিপ্র, নৃশংস আর দুর্ধর্ষ বটে, কিন্তু সেই পরিমাণে কুসংস্কারগ্রস্ত। এদের অনেকটাই ঠান্ডা করে এনেছেন স্লিম্যান। একবার যদি রটে যায় যে দুর্গাশঙ্কর ধরা পড়েছে, অতবড় তান্ত্রিকও নিজেকে বাঁচাতে পারেনি কোম্পানির হাত থেকে, ঠগিদের মনোবল বলে আর কিছু থাকবে না।এই সুযোগটাই স্লিম্যান খুঁজছিলেন অনেকদিন ধরে। চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে ওঁর। এই সুযোগ ফসকে যেতে দেওয়া যাবে না, কিছুতেই না।
কোনো উপায় ঠাকুর? এই শয়তানটাকে আটকাবার কোনো উপায়?
নেই বললেই চলে। এই পণ্ডিত এখনই অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার অধিকারী। সমস্ত উদ্যোগ হেলায় বানচাল করে দিতে পারে। চেষ্টা করাটাই শুধু আমাদের হাতে সাহেব। ঈশ্বর যা চান তাই হবে, না-চাইলে কি আমরা আটকাতে পারব?
আচ্ছা? ঠিক আছে দেখা যাক কে জেতে, কোম্পানির বন্দুক না তোমাদের এইসব তান্ত্রা অ্যান্ড অল। এই বলে চোখ টিপে মুচকি হাসেন স্লিম্যান।
হেসে ফেলেন ব্রাহ্মণটি, ভালো কাজে নেমেছ সাহেব।এদেশের রাজামহারাজারা তো আর আইনের শাসন, প্রজাদের জানপ্রাণ, ভালোমন্দ এসব নিয়ে বিশেষ ব্যতিব্যস্ত নয়, খাজনা আদায় করেই কর্তব্য শেষ মনে করে। তোমরা বিদেশিরা যে নিজেদের জন্যে হলেও এইসব গুন্ডাবদমাশদের ঠান্ডা করতে নেমেছ, এই দেখে আমি প্রাণভরে আশীর্বাদ করলাম। ভয় পেও না। মনে রাখবে মানুষকে ভালোবাসার কাছে সমস্ত অশুভ পূজামন্ত্র ব্যর্থ। ভালোবাসা হল সবচেয়ে বড় তন্ত্র, সবচেয়ে বড় যাদু।
বেরিয়ে যাবার জন্যে পুঁথিপত্র গোটাচ্ছিলেন প্রৌঢ় ব্রাহ্মণটি। স্লিম্যান কাছে গিয়ে দাঁড়ান, তোমার নাম বলে গেলে না ঠাকুর?
উঠে দাঁড়ান ব্রাহ্মণবটু, দুচোখে কৌতুক খেলে যায়, পাল্টা চোখ টিপে মুচকি হাসেন, আমার নাম উচ্চারণ করতে গেলে তোমার দুটো জিভ লাগবে সাহেব। খুব খটোমটো নাম আমার।
হো হো করে হেসে ওঠেন স্লিম্যান, হাসি থামলে বলেন, আচ্ছা বলো তো একবার, দেখি উচ্চারণ করতে পারি কি না।
আমার নাম কৃষ্ণানন্দ, সাহেব, পুরো নাম কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ।
*********
সুবন হরসুকা সত্যিই ক্ষণজন্মা তিলহাই। গতকালই খবর এনেছিল যে এক নিয়ামতে ভিটু, অর্থাৎ ধনী হিন্দু বানিয়া এদিকেই আসছে লটবহর নিয়ে। বানিয়া নিজে, দু চারটে খিদমতগার আর একটি বছর আট দশেকের খোনতুরি, এ ছাড়া আর কেউ নেই সঙ্গে।
ভালোই হল, সুবন ভাবে, দুমাইল দূরেই ঝুরকো ডোঙ্গির ডেরা, এই এলাকার মশহুর ব্রিনজার, বাচ্চা মেয়েটাকে বিক্রি করেও ভালো টাকা পাওয়া যাবে। এক ঢিলে দুই পাখি। এও খবর আছে যে এই বানিয়া, নাম বনোয়ারিলাল, সঙ্গে বেশ কিছু টাকাপয়সা নিয়ে নিজের সসুরাল যাচ্ছে, পুরনো কিছু উধার চুকাবার আছে বলে। এক রাতের রাস্তা ভেবে বেশি লোকজনও সঙ্গে নেয়নি বেওকুফটা।
ভালোই, সুবন ভাবে। বেশি হাঙ্গামা হবে না। অল্প পরিশ্রম, বেশি লাভ।
ঠাকুর অবশ্য আজ ঝিরণী দেওয়ার সময় থাকবেন না। ওঁর নাকি বিশেষ কিছু কাজ আছে। ঝিরণীর পরেই আসবেন। তাতে অসুবিধা কিছু নেই। উনি নিজের প্রাপ্যটুকু বুঝে নিয়ে যাবেন, এতে কার কী বলার আছে? প্রাপ্যটিও তো তেমন বিশেষ কিছু নয়, তবে কিনা বনোয়ারিলাল বেশ নাদুসনুদুস ইনসান বটে, ঠাকুরের বেশ কষ্টই হবে একে টেনে নিয়ে যেতে, ফিকফিক করে হাসতে হাসতে ভাবে সুবন।
একলা একলা এত হাসি কিসের রে সুবনা?পেছন থেকে মোরাদুন জিজ্ঞেস করে, ধাউড় জমাদারও সঙ্গেই ছিল, আরেকটা শাদি করার খোয়াব দেখেছিস নাকি কাল রাতে?
ফিক করে হেসে ফেলে সুবন, না ভাইয়া, ভাবছি যে বানিয়াটা আজ ভবানী মাঈয়ের প্রসাদ হবে, তার কথা। ঘিউ দুধ খেয়ে যা বিশাল শরীর বানিয়েছে না, গর্দন তো বোঝাই যায় না, খোদাবক্স ভাইজান পেলহুটা কোথায় পরাবে তাই ভাবছি, হি হি।
মোরাদুন আর ধাউড়ও হেসে ফেলে। এরা দুজনেই দক্ষ সোথা। শিকারের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে ভুলিয়েভালিয়ে বিশ্বাস উৎপাদন করাই এদের কাজ। এই কাজে গোটা বেহড়ে এদের থেকে নামজাদা লোক আর নেই।
তা সে নামের প্রতি সুবিচার করেই বোকা বানিয়াটির ছোট বহরটিকে লাকরাদৌনের আশেপাশে তাবু ফেলাতে বেশি কসরত করতে হোল না ওদের কাউকেই।
পাঁচটি পুরুষ আর একটি নিপাপবালিকাকে ঘিরে আনন্দ-হাসি-ঠাট্টার মৃত্যুবাসর বসাল প্রায় চল্লিশটি হিংস্র শ্বাপদ!