একটু ঘাবড়ে যায় খোদাবক্স, ভুল কিছু বলল নাকি? নাকি বেটা বললেই সুবিধা হত?
হ্যাঁ ঠাকুর। খুব প্যায়ারি একটা বিটিয়া রানি হয়েছে ওর। বেটি খুব হাসমুখ, সবসময় খিলখিল করছে। সতর্ক হয়ে বলে খোদাবক্স।
বেটি? বাহ, খুব ভালো। খুব গোলমাটোল হয়েছে নিশ্চয়ই? খুব গোরি? খুব হাসে বলছ? খুব প্যায়ারি হয়েছে?
খোদাবক্স একটু ঘাবড়ে যায়। এসব প্রশ্নের উত্তর মোটেই তৈরি করে আসেনি সে। সিলম্যান সাহিবও এসব বলে দেননি যে!!
এই উৎকণ্ঠা থেকে ত্রাণ করলেন ঠাকুর নিজেই। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে গেলেন।
খোদাবক্সকে বিমূঢ় রেখে!
*********
সগরের কোম্পানিকুঠিতে সেদিন সকাল থেকেই সাজো সাজো রব।কলকাতা থেকে খোদ ফিরঙ্গ সেপাই এসেছে পঞ্চাশজন মতন। কী তাগড়াই শরীর তাদের, কী ভাবলেশহীন। মুখ, আর কী কুচকাওয়াজের বহর। তার ওপর বড় বড় বন্দুক এক একজনের কাঁধে। সরু চোখে এসব দেখে যাচ্ছিল ফিরিঙ্গিয়া, আর ভাবছিল এই আদব, এই আরাস্তাগি আছে বলেই না এই ফিরঙ্গরা এত বড় হিন্দুস্তানে থানা গেড়ে বসেছে!
প্রাক্তন ঠগি, বেহরামের পর ভারতবর্ষের দুর্ধর্ষতম ঠগি ফিরিঙ্গিয়া একটু ম্লান হাসি হাসল। সব এদের অধিকারে যাবে। সমস্ত হিন্দুস্তান লাল হয়ে যাবে। এই ফৌজ একদিন দিল্লি থেকে কালিকট, নাগপুর থেকে কলকাত্তা দাপিয়ে বেড়াবে।দুর্বল হিন্দুস্তান চেয়ে চেয়ে দেখবে শুধু।
ভালোই হবে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফিরিঙ্গিয়া। এখনই কি খুব ভালো আছে দেশ? চোর জোচ্চর বাটপাড়ে যে ভরে গেল সব। লাখনৌ আর দিল্লিতে পুরানি খানদানি নওয়াব। আর কলকাত্তায় নয়া বড়লোকদের বাবুয়ানি ছাড়া বাকি দেশে কানুনি হুকুমত আছে। কিছু? ফিরিঙ্গিয়ারা না হয় ঠগি, মা ভবানীর আদেশ ছাড়া মানুষ খুন করে না, শাস্ত্রের আদেশ ছাড়া কাসসিতে হাত অবধি ছোঁয়ায় না। বাকিরা? ধুতুরিয়ারা?ম্যাকফানসারা? ভাঙ্গিরা? ছোটোখাটো জমিন্দারেরা? এক এক জন তো সাক্ষাৎ নরপিশাচ।ওর গাঁয়ের খুনে তহশিলদার ছোটে সিং তোমর ঘরে আগুন লাগিয়ে সব ছারখার করে না দিলে কি ফিরিঙ্গিয়া আজ নামতো এই রাস্তায়?
চিন্তায় বিভোর হয়ে ছিল ফিরিঙ্গিয়া, পাশে স্লিম্যান এসে দাঁড়াতে হোঁশ ফিরে পায়।
কোই হুকুম মেরে লিয়ে, সাহেব?
শুধু রাস্তাটা দেখিয়ে দিলেই হবে। তোমার দোস্ত চিনতে পারবে তো?
বেশকহুজুর, খোদাবক্স খুবই হোঁশিয়ার লোক। আন্ধেরাতেও বিলকুল সাফ দেখে। বিলকুল চিন্তা না করে সাহেব।
বেশ বেশ। আর আজকেই হবে তো ব্যাপারটা? তুমি নিশ্চিত?
হ্যাঁ, সাহেব, পিছন থেকে আওয়াজ আসে, আমার গণনা যদি ঠিক হয়, আর পণ্ডিতজি যা করছেন বলে খবর পেয়েছি তা যদি সাচ্চা হয়, আজই সেই দিন, শুক্লপক্ষের চতুর্দশী।মকরে শনি প্রবেশ করবেন আজ রাতে, কালভৈরবের পূজার জন্যে এর থেকে ভালো দিন পণ্ডিতজি আর পরের পঞ্চাশ বছরেও পাবেন না।
ঘুরে দাঁড়ান স্লিম্যান। এতক্ষণ ধরে পাশের একটা ঘরে ওল্ড কিছু স্ক্রিপচার্স নিয়ে কীসব করছিল এই ব্রাহমিন। ফিরিঙ্গিয়া দেখেই মাটিতে শুয়ে পড়ে, গোর লাগি ঠাকুর।
অনেক খুঁজেপেতে একে নিয়ে এসেছেন স্লিম্যান। এই দেশের ব্ল্যাক ম্যাজিক আর রিচুয়ালসের কিছুই বোঝেন না তিনি। তাই দরকার ছিল এমন একজনের যে পুরো ব্যাপারটা বুঝে একটা ওয়েআউট বলে দেবে। এই ডার্ক ব্রাউন কালারের, শর্ট হাইটের ব্রাহমিনটি বেঙ্গলের লোক, নর্মদার তীরে ফেমাস শিভা টেম্পলে পিলগ্রিমেজ সেরে ফিরে যাচ্ছিল। ফিরিঙ্গিয়াই খোঁজ আনে এই লোকটার। খুবই নাকি পাওয়ারফুল ব্রাহমিন। এ, আর একটা কীসে যেন খুব ফেমাস… কী যেন যেন… ইয়েস, তান্ত্রা!!
তুমি ঠিক বলছ ঠাকুর? একটু সন্দেহই যেন প্রকাশ পায় স্লিম্যানের গলায়।
মৃদু হাসেন সেই ব্রাহ্মণবটু, আমার গণনা কখনো ভুল হয় না সাহেব। তোমরা যা বললে, সব শুনে মনে হচ্ছে আজই সেই দিন। আর যদি দুর্গাশঙ্কর পণ্ডিত এই সাধনায় সফল হন, মহা অনর্থ হয়ে যাবে সাহেব, চোখ বুজে শিউরে উঠলেন তিনি।
কীসের অনর্থ ঠাকুর? কৌতূহলী হয়ে ওঠেন স্লিম্যান।
তুমি বুঝবে না সাহেব। আমার জ্ঞানমতে গত পাঁচশো বছরের মধ্যে এই সাধনপথে এগোবার সাহস করেনি কেউ। শবসাধনা বোঝো সাহেব? একটি সদ্যমৃত লাশ নিয়ে সারারাত একা নির্জন শ্মশানে বসে ভয়ঙ্কর সাধনা। অনেক তান্ত্রিকের জীবনে। একবারও শবসাধনা করার সৌভাগ্য হয় না। আর ইনি একের পর এক শবসাধনা। করে চলেছেন… এর একটাই মানে হয়… মুখ যেন বিবর্ণ হয়ে যায় সেই খর্বকায়। ব্রাহ্মণের, আর যদি তাই হয়, পণ্ডিতজিকে আটকানো জরুরি, খুব জরুরি। ভগবান না করুন, আজই যদি একশো আটতম সাধনা পূর্ণ হয়… বলে ফের শিউরে উঠলেন। তিনি, হাতদুটো বুকের মধ্যে রেখে বিড়বিড় করে ইষ্টনাম স্মরণ করেন।
একশো আট? মুহূর্তের মধ্যে আঁতকে ওঠেন স্লিম্যান, বুকে দ্রুত ক্রুশচিহ্ন আঁকেন, মাই গুডনেস। কী বলছ কী ঠাকুর? আর যদি দুর্গাশঙ্কর সাকসেসফুল হয়ে যায়, তা হলে কী হবে ঠাকুর? বললে না যে?
নিজের ইচ্ছেমতন একজন মৃত মানুষকে ফের বাঁচিয়ে পৃথিবীতে ফেরত আনতে পারবেন উনি। বুঝে দেখো সাহেব, এ কত বড় ক্ষমতা! খুবই গূঢ় তন্ত্রসাধনা এই কালভৈরবপূজা, অতি অল্পসংখ্যক লোকই জানে। কেউ প্রয়োগ করার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবে না। উনি যে শুধু ভেবেছেন তাই নয়, নির্ভুল লক্ষ্যে মাপা ছক কেটে এগিয়েছেন, সহজে লাশ পাবেন বলে ঠগিদের দলেও ভিড়েছেন। বহুদিনের পরিকল্পনা আর অলৌকিক শক্তি ছাড়া এসব হয় না সাহেব। যেভাবে ভুকোত জমাদারকে বশ করেছেন। বলে শুনলাম, উচ্চকোটির পিশাচসিদ্ধ না হলে এ ক্ষমতা সম্ভব নয়।