আচ্ছা, এই নাম-অ্যাড্রেস তো পিকুর কাছেই আছে। বাড়িটা যখন অ্যান আবারে, যাওয়াটা শক্ত কিছু নয়। একবার গিয়ে খোঁজ নেবে কি?
হয়তো ডেভ জর্ডনের পরিবারের কেউ এখনও ওখানে থাকেন। হয়তো বাবার সম্বন্ধেও কিছু বলতে পারবে।
পরের দিন কাগজটা খুলল পিকু। 20 এপ্রিল 2002। ক্র্যাশের খবরটা নিউইয়র্ক টাইমসের প্রথম পাতা জুড়ে। ক্র্যাশসাইটের কয়েকটা টুকরো ছবি। প্লেনের ছোট ছোট কয়েকটা টুকরো। একটা আধপোড়া জুতো। এ ধরনের প্লেনে আগে কখনও এরকম বিপর্যয় ঘটেনি। প্রাথমিকভাবে যেভাবে হঠাৎ করে ভেঙে পড়েছে তা দেখে অনুমান করা হচ্ছে বিমানে কোনও বিস্ফোরণ হয়েছিল। ডেটা রেকর্ডার–ভয়েস রেকর্ডার খুঁটিয়ে দেখা হচ্ছে। টেররিস্টদের হাত থাকলেও থাকতে পারে।
22 এপ্রিলের কাগজের দ্বিতীয় পাতায় বড় করে বিমান দুর্ঘটনার প্রতিবেদন। তাতে প্লেনের সব যাত্রীদের ছবিও আছে। বাবারও ছবি আছে দ্বিতীয় সারিতে। চুপ করে ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইল পিকু। কত আপনজন একমুহূর্তে কত দূরে চলে যায়। বাবার মুখে সেই ছেলেমানুষি হাসি। তাহলে খবরটায় কোনও ভুল নেই। অন্তত প্লেন অ্যাক্সিডেন্টে বাবার মৃত্যু নিয়ে কোনও রহস্য নেই। তবু–তবু কেন পিকুর আজও মনে হয় সব তথ্য ভুল। আজও মনে হয় মানুষটা সামনেই জলজ্যান্ত দাঁড়িয়ে আছে।
আরেকটা কথা খেয়াল হল, বাবার পাসপোর্ট নাম্বার আর আমেরিকার স্যোশাল সিকিওরিটি নাম্বার তো পিকুর কাছেই আছে। তার থেকেও যদি কিছু সূত্র পাওয়া যায়। গত কয়েকবছর আমেরিকাতে প্রত্যেকের বায়োমেট্রিক আইডেনটিফিকেশনের জন্য কার্ড চালু হয়ে গেছে। কিন্তু আগের স্যোশাল সিকিওরিটি নাম্বার দিয়েও যে কারও সব তথ্য খুঁজে বের করা যায়।
পিকু ইন্টারনেটে সার্চ করল ওই নাম্বার ধরে। ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করে এরকম একটা বিশেষ সংস্থা ওই নাম্বারের ওপর নির্ভর করে কোনও ব্যক্তির যাবতীয় তথ্য সামান্য চার্জের বিনিময়ে জানিয়ে দেয়। তাতে সার্চ করতে জয়ন্ত চ্যাটার্জির আমেরিকায় থাকার যাবতীয় ইতিহাস চট করে পেয়ে গেল পিকু। 86 থেকে 93 বস্টন। দুটো ডিফারেন্ট অ্যাড্রেস। তারপর 93 থেকে 97 ডেনভার কলোরাডোতে। 97-এর শেষের দিকে কলকাতায়।
কিন্তু এসব অ্যাড্রেসের বাইরেও আরেকটা অ্যাড্রেস দেখাচ্ছে জয়ন্ত চ্যাটার্জির নামের সঙ্গে। 91 থেকে 2002। আর সেটা অ্যান আবারের অ্যাড্রেস, অর্থাৎ যেখানে পিকু এখন আছে।
অ্যান আর্বারে বাবার থাকার কী কারণ? আর তা কেউ জানত না কেন? দ্রুত ওই অ্যাড্রেসটা নোট করে নিল পিকু।
আর মিনিট পাঁচেক বাদে পিকু লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এল। সুবীরবাবু বাইরে অপেক্ষা করছেন।
কী কাকু, আপনি ভেতরে এলেন না কেন?
এসেছিলাম বাবা। একজনের সঙ্গে একটু আলাপ করছিলাম। লোকটাকে আমার চেনা। চেনা মনে হচ্ছিল। জিগ্যেস করছিলাম কোথায় থাকে, কী করে ইত্যাদি। তারপর সুপারবোল খেলা, আজকের ওয়েদার এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলছি, হঠাৎ দেখি লাইব্রেরির সিকিউরিটি এগিয়ে আসছে। কথা বলা বারণ। তাই আমাকে নাকি বাইরে বেরিয়ে কথা বলতে হবে। বোঝো! লোকটাকেও আসতে বললাম বাইরে। তা তার নাকি ভেতরেই একটু কাজ আছে। এলো না। অগত্যা একা দাঁড়িয়ে। যত সব নিয়ম! তা এবার কোথায় যাবে?
–এই অ্যাড্রেসটায় যেতে পারলে ভালো হত। তা এখন আপনার সময় হবে কি?
কীসের অ্যাড্রেস?
বাবা কোনও একটা সময়ে ওই ঠিকানায় ছিলেন। ইন্টারনেটে পেলাম। অ্যান আবারেই। তাই ভাবলাম যদি যাওয়া যায়।
–আরে অবশ্যই, এখনই চলো।
সুবীর বাবুর ফোর্ড গাড়িতে উঠে বসল পিকু। উনি ধারাভাষ্য শুরু করলেন, বুঝলে পিকু, অ্যান আবার কিন্তু খুব পুরোনো শহর। মিসিগান ইউনিভার্সিটির বয়সই তো কয়েক হাজার বছর।
বলে পাশে বসা পিকুর মুখের হাসিটা দেখে বলে উঠলেন,–আহা, দুশো বছর কি কম হল! 1817 সালে মিসিগান ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এখানকার ইঞ্জিনিয়ারিং, সারা বিশ্বের সেরা।…
জিপিএস অনুযায়ী গাড়ি ছুটে চলল অ্যান আবারের রাস্তা ধরে। ইউনিভার্সিটি, মিসিগান হসপিটাল পেছনে ফেলে গাড়ি এগিয়ে চলল দক্ষিণ শহরতলীর দিকে। প্রায় আধঘণ্টা বাদে একটা মাটির রাস্তায় এসে পড়ল ওরা। প্রাইভেটলি মেনটেন্ড রাস্তা। ধারে সাইনবোর্ডে লেখা দেখে বোঝা গেল যে হরিণ যে-কোনও সময়ে রাস্তা পেরোতে পারে। বাঁদিক-ডানদিকে বেশ খোলা খোলা মাঠ, ভুট্টাখেত। একটা বড় খামারবাড়ির সামনে এসে গাড়ি দাঁড় করালেন সুবীরবাবু।
–এসে গেছি। দুম করে ঢুকো না। ট্রেসপাসিং হবে। বাড়ির লোক সেরকম সহৃদয় না হলে গুলিও চালাতে পারে।
অগত্যা দূরে থেকেই অপেক্ষা। তিনতলা বিশাল বাড়ি পাম গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে। মাঝে সুরকি ফেলা পথ। গেটের ওপরে বড় করে লেখা স্ট্রাইবারস।
বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হল না। এক বিশাল চেহারার মাঝবয়সি কালো মহিলা গেটের দিকে আসছেন। নিশ্চয়ই গেটে বসানো সিকিওরিটি ক্যামেরায় দেখেছেন। বেশ কড়া গলায় বলে উঠলেন, কী দরকার? কাকে চাই?
সুবীরবাবু থতমত খেয়ে বলতে শুরু করলেন।
পিকুর বাবার এয়ারক্র্যাশে মৃত্যু থেকে শুরু করে পিকুর আমেরিকায় আসা আর বাবার নাম দিয়ে সার্চ করে এখানকার অ্যাড্রেস খুঁজে পাওয়া–পুরোটাই সুবীরবাবু বললেন। যখন ওনার বলা শেষ হল, তখন ওই মহিলার চোখে জল।