তবে কী কাকু?
নাহ্, সে তেমন কিছু নয়। তবে সুবীরের ছেলে পিলে হয়নি। স্ত্রী-ও মারা গেছেন। একটু বেশি কথা বলে। আর
–আর, আর কী?
বাঙালির যা অভ্যেস, একটু বাড়িয়ে বলে। হেসে উঠলেন অরিন্দমকাকু।
.
১০.
কলকাতা থেকে দুবাই। দুবাই থেকে ডেট্রয়েট। আজকালকার দিনে প্রায় সবাই ছোটবেলা থেকেই প্লেনে চড়ে। পিকুর অবশ্য এবারই প্রথম। আর প্রথমবারেই এতটা পথ। তাই সময় যেন কাটতেই চাইছিল না।
ডেট্রয়েট যখন পৌঁছোল তখন ওখানে সন্ধে। ইমিগ্রেশনের বিশাল লাইন। তবে খুব সুন্দরভাবে পরিচালনা করায় বেশ তাড়াতাড়ি লাইন থেকে বেরিয়ে গেল।
লাগেজ নিয়ে এয়ারপোর্টের বাইরে বেরিয়ে ফোন করল সুবীর রায়কে। এয়ারপোর্টের কাছেই গাড়ি পার্ক করে উনি পিকুর ফোনের অপেক্ষা করছিলেন। মিনিট দশেক বাদে পিকু দেখল অদ্ভুত সবুজ রঙের একটা বিশাল গাড়ি ওর দিকে এগিয়ে আসছে। গাড়ি থামতে এগিয়ে গেল পিকু। ভদ্রলোক দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন।
–পিকু?
–হ্যাঁ।
–আরে আমি অনেকক্ষণ এসে গেছি। ভাবলাম ফ্লাইট যদি আগে পৌঁছে যায়। নাও, গাড়িতে ওঠো, আমার বাড়িটা অ্যান আবারের নর্থ-ওয়েস্ট সাবার্বে। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মতো লাগবে।
–তা আপনি তো এখানে বহুদিন আছেন, আমার বাবাকে চিনতেন না? জয়ন্ত চ্যাটার্জি।
–না, আসলে আমার তো এখানে ব্যবসা। আগে সানফ্রান্সিসকোতে ছিলাম।
একটু থেমে সুবীরবাবু বলে উঠলেন, তোমার বাবা তো এয়ার অ্যাক্সিডেন্টে মারা গিয়েছিলেন, তাই না?
–হ্যাঁ, আমেরিকান এয়ারলাইনস। 2002-এর 18 এপ্রিল।
–আমার মনে আছে ইনসিডেন্টটা। প্লেনটা ভেঙে পড়ে ডেট্রয়েট থেকে দুশো মাইল দূরে। চুপ করে গেলেন সুবীর রায়।
পাশে পিকু জানলার দিকে তাকিয়ে বসে আছে। পিকুর উদাসীন হওয়ার কারণটা বুঝতে পেরে ফের বলে উঠলেন, বুঝলে, আমার দারুণ লাগছে। এতদিন বাদে বাড়িতে একজন বাঙালি অতিথি। এক সময় তবু বন্ধু-বান্ধবদের যাতায়াত ছিল। এখন সবাই ভিডিয়ো ফোনে খোঁজ নেয়। কেউ আর আরেকজনের বাড়ি যায় না। আমার বাড়িটা বিশাল। লাগোয়া বাগানটাও বেশ বড়। ওখানে শয়ে শয়ে হরিণ আসে। লুকোচুরি খেলে।
বলেই পিকুর অবাক চোখের দিকে তাকালেন, শখানেক না হলেও দু-তিনটে রেগুলার আসে। তা যা বলছিলাম, তুমি কি এখানে কোনও কাজে এসেছ?
–হ্যাঁ, আমি আমার রিসার্চ সংক্রান্ত কিছু কাজ নিয়ে এসেছি। তাছাড়া বাবা তো এখানেই মারা গিয়েছিলেন, তাই জায়গাটা দেখার ইচ্ছে আছে। বাবার শেষ দিকের রিসার্চ নিয়েও একটু খোঁজ খবর নেব।
অরিন্দমকাকু পিকুকে আগেই বলে রেখেছিলেন আসার আসল কারণটা সুবীর রায়কে আসামাত্রই না বলতে। সাদাসিধে লোক–অহেতুক সবাইকে বলে বেড়াবেন। আপাতত গাড়ি ইন্টারস্টেট রাস্তার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। পাশে একটা গাড়িকে পুলিশ ধরেছে। রোবট পুলিশ। সাইডে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়েছে।
ওদিকে তাকিয়ে সুবীরবাবু বলে উঠলেন,–এদের চোখ এড়ানোর উপায় নেই। একটু নিয়ম ভাঙলেই ফলো করে এসে ঠিক ধরবে। আজকাল আমেরিকায় এ ধরনের রুটিন কাজে মানুষের বদলে রোবট ব্যবহার করা হচ্ছে।
–বলে একবার আড়চোখে তাকালেন পিকুর দিকে। ফের বলতে শুরু করলেন,–তা বলে এদের হাবাগোবা ভেবো না। ওরকম পিটপিটে চোখ, বোকা বোকা চেহারা হলে কি হবে! আইনজ্ঞান টনটনে। কয়েকদিন আগে একটা স্টেট হাইওয়ে দিয়ে যাচ্ছি, হঠাৎ মনে হল আমার। পুরোনো এক বন্ধু কল্যাণ যেন উলটোদিকে গাড়ি চালিয়ে চলে গেল। ওর সঙ্গে আমার বহুদিন যোগাযোগ নেই। তাই টুক করে গাড়ি ঘোরালাম। যেখানে ঘোরালাম, সেখানে ঘোরানোটা নিষিদ্ধ। কিন্তু কলকাতার অভ্যেস যাবে কোথায়! যেই ঘুরিয়েছি দেখি সাইরেন বাজিয়ে এক পুলিশের গাড়ি হাজির। একটা বড় রকমের ফাইন। তা সে না হয় দিলাম। মনে হল রোবট পুলিশটার সঙ্গে একটু আড্ডা মারি। বন্ধু হারিয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে যদি মেটানো যায়। বুঝিয়ে বলি কী জন্য ঘোরালাম। বন্ধুদের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে একটু বোঝাই। আজকের দিনে স্কুলের বন্ধুর সঙ্গে হঠাৎ করে রাস্তায় দেখা পাওয়া কতটা ভাগ্যের ব্যাপার। ভালোরকম বোঝালাম। দেখি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনল। বারদুয়েক থ্যাংক-ইউ ও বলল। তারপর দেখি আবার ফাইন করেছে। এবারের কারণ ওর অহেতুক সময় নষ্ট করা। বোঝো!
ঠিক পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগল। সুবীর রায়ের বাড়িটা বেশ ফাঁকা জায়গায়। শহরের একটা প্রান্তে। দেখেই বোঝা যায় বেশ উচ্চবিত্তদের পাড়া। বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে বাড়িটা। গ্যারেজে গাড়ি পার্ক করে সিকিওরিটি কোড দিয়ে দরজা খুলে বাড়ির ভেতরে ঢুকল ওরা।
৩. ডিজিটাল কপি আর্কাইভ
এখানে একটা বড় সুবিধে হল সব ইনফরমেশনই চট করে খুঁজে পাওয়া যায়। অ্যান আবারের লাইব্রেরিতে 2002-এর 19 এপ্রিলের খবরের কাগজটা খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না। ডিজিটাল কপি আর্কাইভ করা ছিল। সেটাতে চোখ বোলাল পিকু।
নিউইয়র্ক থেকে ডেট্রয়েট যাচ্ছিল আমেরিকান এয়ারলাইনসের ফ্লাইট E120। তিরিশ জন যাত্রী ছিল তাতে। বেশিরভাগই বিজ্ঞানী। জেনেটিক সায়েন্সের ওপর এক কনফারেন্সের পর ডেট্রয়েট ফিরছিলেন তারা। পথে প্লেন দুর্ঘটনা হয়–সকাল সাড়ে ছটার সময়। ডেডবডিগুলো সনাক্ত করা যায়নি। নামের লিস্ট আছে–চোখ বোলাতেই তাতে ঝাপসা চোখের সামনে জয়ন্ত চ্যাটার্জির নামটা দেখতে পেল পিকু। খবরটা তাহলে মিথ্যে নয়। অন্যান্য যাত্রীর নামের মধ্যে আরেকটা পরিচিত নাম পেল পিকু। ডেভ জর্ডন। এরই নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার, বাবার ডায়েরিতে পেয়েছিল পিকু।