মিঃ বকসির চেম্বারে ওনার সেক্রেটারি সীমার সঙ্গে একজন ছেলে এসে ঢুকল।
বসার সিট দেখিয়ে মিঃ বকসি ছেলেটার দিকে তাকালেন। চেহারার মধ্যে সম্ভ্রান্ত বংশের ছাপ। চোখদুটো খুব উজ্জ্বল। চশমাতেও সেই ঔজ্জ্বল্য ঢাকা পড়েনি। একটু যেন অস্থিরতার ভাব। হাতে একটা ফাইল। টেবিলের ওপর ফাইলটা রেখে একটা চিঠি বার করে মিঃ বকসির দিকে এগিয়ে দিল।
অতবছর আগের সব চিঠিপত্র নেই, তবে পুরোনো কাগজপত্র ঘেঁটে একটা চিঠি। পেলাম।
–দেখি–! মিঃ বকসি অভিজ্ঞ চোখে চিঠিটাতে চোখ বোলালেন। ইনোভেটিভ সলিউশনসের লেটার হেডে। জয়ন্তর মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করে সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট চিঠি দিয়েছেন। জানিয়েছেন দশ লাখ টাকা অর্থ সাহায্যের কথা। কিন্তু যার নাম সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে উল্লিখিত, সেই এন নরসিহন–নাহ্, মিঃ বকসি নামটা খেয়াল করতে পারলেন না।
–এই চিঠিটা রাখতে পারি? আমাদের একটু সময় দিতে হবে। দু-তিন দিনের মধ্যে চিঠিটা আসল না নকল তা বলে দিতে পারব।
–বুঝলাম না, আপনার কি মনে হয় চিঠিটা আসল নয়?
এমনিতে সন্দেহ করার কিছু নেই। তবে সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট বলে যার নাম আছে, সেই এন নরসিমহন বলে কেউ ছিলেন না। তবু আমরা আমাদের সব রেকর্ড দেখব। তা, তোমার বাবার ছবি, পাসপোর্ট এসব কিছু আছে?
–হ্যাঁ, বলে এগিয়ে দিল পিকু, তবে বাবা তো সঙ্গে করে পাসপোর্ট নিয়ে গিয়েছিলেন। অনেক খুঁজে পাসপোর্ট-এর প্রথম দুটো পাতার কপি পেয়েছি। আপনি এটাও রাখতে পারেন। আমার কাছে কপি আছে।
–গুড! মিঃ বকসি একটু থামলেন। তিরিশবছরের চাকরিতে অনেক কিছু দেখেছেন, কিন্তু এরকম ঘটনা কখনও হয়নি। ডিটেকটিভের ভূমিকায় নিজেকে ভেবে নিয়ে বললেন, তা তোমার বাবার কোনও বন্ধু ছিল না? এ অফিসের কারও নাম জানতে?
–না, আসলে আমি তখন খুব ছোট ছিলাম। মা-ও মারা গেছেন দু-বছর হল। বাবার এক স্কুলের বন্ধুর সঙ্গে কথা বললাম, উনিও কিছু বলতে পারলেন না।
–আশ্চর্য! ঠিক আছে চিন্তা কোরো না। আমরা দু-তিন দিনের মধ্যেই জানিয়ে দেব যে উনি আমাদের অফিসে কাজ করতেন কিনা।
ধন্যবাদ জানিয়ে পিকু মিঃ বকসির চেম্বার থেকে বেরিয়ে এল।
পিকু বেরোনোর পর মিঃ বকসি সেক্রেটারিকে একবার ডেকে নিলেন।
সীমা, ছেলেটাকে সবরকমভাবে সাপোর্ট করো, আমি নিশ্চিত যে চিঠিটা জাল। কিন্তু প্রশ্নটা হল হুবহু কোম্পানির লেটারহেডে কে চিঠি লিখল, আর কেই বা কমপেনসেশন পাঠাল? আর এন নরসিহন-ই বা কে? এমপ্লয়ি ডেটাবেসের সঙ্গে ছেলেটির বাবার ছবিটাও মিলিয়ে নিও।
.
০৯.
জীবনটা কোনওদিনই খুব সহজভাবে ধরা দেয়নি পিকুর কাছে। খুব হিংসে হত যখন স্কুলে দেখত অন্য ছেলেরা বাবার হাত ধরে যাচ্ছে। মনে হত ম্যাজিকের মতো যদি ওর বাবাও এসে হাজির। হত! এত বছরে ব্যাপারটা অবশ্য খানিকটা মেনে নিয়েছিল। কিন্তু গত কয়েকদিনে জীবন যেন ওকে নিয়ে ফের ঠাট্টা করতে শুরু করেছে। একের পর এক অচেনা তথ্য সামনে এসে জড়ো হয়েছে।
ইনোভেটিভ সলিউশনস থেকে মিঃ বকসি ফোন করেছিলেন দুদিন বাদে। জয়ন্ত চ্যাটার্জি বলে কোনও সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার কোনওকালে ওই কোম্পানিতে কাজ করেনি। চিঠিটাও ভুয়ো। তাহলে প্রশ্ন, তখন অত টাকা পাঠাল কে? ওই টাকা না পেলে ওদের সংসারও চলত না।
অনেকদিন আগের কথা। ব্যাঙ্কে খোঁজ নিয়েও কিছু জানা যায়নি।
এসব নিয়ে পিকু ভাবছে, হঠাৎ কলিংবেল বাজল। ক্যামেরায় পিকু দেখতে পেল বাইরে। অরিন্দমকাকু। সঙ্গে সঙ্গে রিমোটে দরজা খুলে দরজার দিকে এগিয়ে গেল পিকু। ঢোলা প্যান্ট, আগেকার দিনের চশমা আর ছাতা, অরিন্দমকাকুকে দেখলেই মনে হয় সময় যেন আর এগোয়নি। সেই কুড়ি বছর পিছিয়ে আছে। সবসময় মুখে হাসি।
পিকুর পিঠে চাপড় মেরে সোফার দিকে এগিয়ে গেলেন অরিন্দমকাকু।
বুঝলি পিকু, আরেকটা ইন্টারেস্টিং খবর চোখে পড়ল। বলে একটা পুরোনো খবরের কাগজ এগিয়ে দিলেন। নিউইয়র্ক টাইমস। 1998, 17 জুলাই। লাইব্রেরির আর্কাইভ ঘাঁটতে গিয়ে চোখে পড়ল। ছবিটা দ্যাখ।
–একী! এ তো বাবার ছবি!
–হ্যাঁ, জয়ন্তর ছবি। শুধু তাই নয়, যাদের সঙ্গে ছবি তোলা তারা প্রত্যেকেই বিখ্যাত জেনেটিক সায়েন্টিস্ট। ছবিটা অ্যান আবারে, ইউনির্ভাসিটি অফ মিসিগানে তোলা। সঙ্গের লেখাটা পড়। জেনোম রিসার্চে যে টিম কাজ করছিল তার ছবি নাকি এটা।
–আশ্চর্য, বাবার তো অন্য প্রফেশন–উনি জিন-এর রিসার্চের সঙ্গে যুক্ত হলেন কী করে?
–আমিও তাই ভাবছি। জয়ন্ত খুবই ব্রিলিয়ান্ট ছেলে ছিল। তখনকার দিনে আমাদের বোর্ডের টপার। প্রচণ্ড হাই আই কিউ ছিল। তা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার পর ও যখন মাস্টার্স করতে বিদেশে গেল, তখন ওর সাবজেক্ট কী ছিল তা আমার জানা নেই। তারপর তো ও ওখানে ডক্টরেটও করেছিল। ও এসব নিয়ে কখনও আলোচনা করত না।
একটু থেমে অরিন্দমকাকু আবার বললেন, আমি বলি কি পিকু, এখানে বসে না থেকে আমেরিকায় চলে যা। যা কিছু ঘটেছে, সবই তো ওখানে।
–কিন্তু আমেরিকা তো একটা বিশাল দেশ। যাব কোথায়?
–কেন? তুই ইউনিভার্সিটি অফ মিসিগান দিয়েই শুরু কর। অর্থাৎ ডেট্রয়েট–অ্যান আবার। ওখানে নিশ্চয়ই কোনও সূত্র পাবি। আর আমার এক বন্ধু সুবীর রায় ওখানেই থাকেন। তুই ওখানেই গিয়ে উঠতে পারিস। তবে