খানিক ভেবে অরিন্দমকাকুর নাম্বারটা বের করে ফোন করে পিকু। অরিন্দমকাকু বাবার বিশেষ বন্ধু ছিলেন। ওনার সঙ্গে একবার কথা বলা দরকার।
.
০৭.
–কী খবর? এতদিন বাদে পিকু সাহেবের ফোন?
কাকু একটা জরুরি দরকারে তোমাকে ফোন করছি।
–হ্যাঁ, কী ব্যাপার বল।
–শোনো, আমি সেদিন একটা পুরোনো লুডো খুঁজে পেয়েছি। এটা আমি আর বাবাই। একসঙ্গে বসে খেলতাম। বহু বছর আগে। বাবাই আমেরিকা যাওয়ার দুদিন আগেও খেলেছি। ওই লুডোর বোর্ডে দুটো সংখ্যা মার্ক করা ছিল, আর সেটা হল বাবার মৃত্যুদিন।
আশ্চর্য! তা তোর কী মনে হয়? পরে কেউ ওই বোর্ডে মার্ক করতে পারে?
না, তার সম্ভাবনা খুব কম। বাবাই-এর মারা যাওয়ার খবরটা পেয়ে আমি রেগে ওই লুডোটা বইয়ের আলমারির পেছনে ফেলে দিয়েছিলাম। তারপর ভুলেও গিয়েছিলাম। এতদিন বাদে ঠিক ওই জায়গাতেই লুডোটা পাওয়া গেছে। অর্থাৎ কারও ওই লুডোতে হাত দেওয়া সম্ভব ছিল না।
–তাহলে কী হতে পারে? কোনওভাবে মিলে গেছে।
আমার খুব স্পষ্ট মনে আছে। বাবাই আর আমি খেলছিলাম–একটা ফোন এল। বোধহয় বাইরের ফোন। আমার মনে হয়, তখনই বাবাই ওটা লেখে।
–তাহলে কী হতে পারে? এটা তো কোনওভাবেই এক্সপ্লেন করা যাচ্ছে না। তবে তুই বললি বলে মনে পড়ল। তোর বাবা তো প্রায়ই বাইরে যেত। তা সেবারে যাওয়ার আগে কেন জানি আমার কাছে এল। সন্ধেবেলা–আমি সবে অফিস থেকে ফিরেছি। কথায় কথায় বলল, তোর আর তোর মার ওপর যেন খেয়াল রাখি। আর কোথায় কোথায় ওর ফিক্সড ডিপোজিট, ইনসিওরেন্স আছে, তার ডিটেলসের একটা প্রিন্ট আউটও নিয়ে এসেছিল। তাহলে কি ও টের পেয়েছিল যে ওর মৃত্যু হতে পারে–কে জানে?
–এটাও তো হতে পারে যে ওটা কোনও প্ল্যানড মার্ডার। বাবাইকে কোনও ঘটনার শিকার হতে হয়েছিল। বাবাই কোনওভাবে জানতেন ঘটনাটা ওই দিনেই হবে। আচ্ছা কাকু, বাবাই-এর অফিসে গিয়ে একবার খোঁজ নিলে কেমন হয়?
–ঠিক বলেছিস। তুই বড় হয়েছিস, তাই তোকে বলি। তোর বাবা আমার খুব বন্ধু ছিল বটে, কিন্তু আমরা তো স্কুলের বন্ধু। ওর কোনও অফিসের বন্ধু সেরকম ছিল না। শুধু তাই নয়, ও অফিসের ব্যাপারে কোনও কথাই প্রায় বলত না। শুধু জানতাম যে ও ইনোভেটিভ সলুশনস-এ কাজ করে।
–আচ্ছা কাকু, আমার কি কোনও দাদা ছিল, ঠিক আমারই মতো দেখতে?
কী আবোল তাবোল বলছিস! দাদা থাকলে তুই জানবি না? আমি জানব না? কেন, হঠাৎ করে মনে হল কেন?
–আমার কেন জানি না, ছোটবেলা থেকেই মনে হত যে আমার সঙ্গে কারও অদৃশ্য প্রতিযোগিতা চলছে। কমপ্যারিসন। বিশেষ করে মার কথায়। হয়তো খাচ্ছি মা হঠাৎ বাবাইকে বলে উঠত দ্যাখো ঠিক ওর মতো খাবার ধরন। মুখে খাবার টোপলা করে রেখে দেয়। অথবা হয়তো বাবার সঙ্গে খেলছি, বাবা বলে উঠত–এ-ও দেখবে, খুব ইনটেলিজেন্ট হবে। কীরকম চটপট ধাঁধাগুলোর উত্তর দিচ্ছে দেখছ। একমাত্র ও ছাড়া আর কাউকে এরকম চটপট উত্তর দিতে দেখিনি।
–তা তোর হঠাৎ করে একথা খেয়াল হল কেন?
কাল আমি একটা ছবি পেয়েছি। বাবার লেখার আলমারি থেকে। চট করে দেখলে মনে হবে আমার ছবি। কিন্তু পরে খুঁটিয়ে দেখে মনে হয়েছে ওটা আমার নয়। একই বয়সের আমার ছবির খুব কাছাকাছি কিন্তু আমি নই।
ভারতে ফেরার আগে তোর বাবা প্রায় বারো বছর আমেরিকাতে ছিল। তখন আমার সঙ্গে বিশেষ যোগাযোগ ছিল না। তবে…।
কী, কাকু? তবে কী? মনে হচ্ছে তুমি আমার কাছে কিছু লুকোচ্ছ। কাল ওই ছবিটা পাওয়ার পরে অনেক খোঁজাখুঁজি করি। একটা পুরোনো অ্যালবামে আরও কিছু ছবি পাই। ওই ছেলেটারই। ছবিগুলো বিদেশের। দেখেই বোঝা যায়। আমি তো কখনও বিদেশেই যাইনি। তুমি লুকিও না কাকু, আমার জানা দরকার, হয়তো বাবার মৃত্যু আর এটা রিলেটেড।
খানিকক্ষণ চুপ থেকে অরিন্দম বলে,–জেনেই যখন গেছিস–তখন বলছি। তোর বাবা আর মাকে কথা দিয়েছিলাম যে এ ব্যাপারে আমি তোকে কোনওদিন কিছু জানাব না। হ্যাঁ, তোর এক দাদা ছিল। বছর পাঁচেক বয়সে মারা যায়। এটা আমেরিকাতে থাকাকালীন হয়। আমি কখনও তাকে দেখিওনি।
–আমি তাহলে একইরকম দেখতে হলাম কী করে?
–সেটা জানি না। আমি তাকে দেখিওনি। এ রহস্যটা উদ্ধার করতে হবে।
.
০৮.
স্যার, একটা ছেলে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।
–কেন?
–ওর বাবা জয়ন্ত চ্যাটার্জি নাকি আমাদের কোম্পানিতে কাজ করত কুড়ি বছর আগে। কিন্তু আমরা কোম্পানি রেকর্ডে কোথাও পাইনি।
–রেকর্ড ভালো করে দেখেছ?
–হ্যাঁ। ছেলেটা বেশ কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করছে। ওর বাবা কুড়ি বছর আগে মারা যান। আমাদের কোম্পানির কাজে আমেরিকায় গিয়ে। মারা যান 2002-এ। এয়ার ক্র্যাশে।
–2002-তে তো আমিও ছিলাম। ওরকম কোনও ইনসিডেন্ট তো মনে পড়ছে না।
–হ্যাঁ, স্যার আমিও আমাদের সব রেকর্ড দেখেছি। এরকম কোনও এমপ্লয়ির মারা যাওয়ার কথা কোথাও নেই।
–তা ছেলেটা কুড়ি বছর বাদে এসেছে কেন? দাবিদাওয়া নিয়ে?
না, না, ছেলেটার কোনও দাবিদাওয়া নেই। এমনকী বলেছে যে আমাদের কোম্পানির থেকে ভালোরকম কমপেনসেশনও নাকি পেয়েছে। তা না হলে ওদের সংসারই চলত না।
ইন্টারেস্টিং! পাঠাও তো ছেলেটাকে। দেখি কথা বলে। তুমিও থাকো। বললেন, মি. বসি। উনি ইনোভেটিভ সলিউশনসের ইস্টার্ন রিজিয়নের হেড। ইনোভেটিভ সলিউশনস এখন সারা পৃথিবীর প্রথম দশটা আইটি কোম্পানির মধ্যে পড়ে। তবে কুড়ি বছর আগে সেরকম ছিল না। তখন মোটে হাজার দুয়েক কর্মী ছিল। একজন আরেকজনকে ভালোরকম চিনত।