অপারেশন যে সবসময় সফল হয় তা নয়। তবে অত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নয়। পিকু। তাই গ্যারেজটা হল ওই সব পেশেন্টের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট।
আজকের পেশেন্ট বহুদিনের পুরোনো কম্পিউটার, স্টার্ট হয়েই আপনা থেকে শাট ডাউন হয়ে যায়। এ সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে আজ বাবার কথা খুব মনে হচ্ছে। এই কম্পিউটারেই বাবা কাজ করত। মাঝে কুড়ি বছর পেরিয়ে গেছে। অনেক স্মৃতি অস্পষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু বাবার সঙ্গে কাটানো প্রত্যেকটা মুহূর্তের রং আজও ফিকে হয়নি। আজও অনেক রাতে বাবার স্বপ্ন দেখে মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে বসে পিকু। আর ঘুম আসে না। বাবার দেওয়া ছোট ছোট ধাঁধাগুলো চোখের সামনে ভাসে। বলতো সোনা, এই ঘরেই আছে তিন হাত তিন দিকে, শুয়ে থাকে শীতে সুখে।ফ্যান।
তখন না পারলেই বাবার ওপর রাগ করত। তর্ক করত। কিন্তু কীভাবে জানি এসব কিছুই নেশা হয়ে উঠেছিল পিকুর কাছে। স্কুল ফেরত অন্য ছেলেরা যখন ভিডিয়ো গেমস খেলত–ও মজে থাকত ধাঁধায়। মনে হত ধাঁধার ওপারেই দাঁড়িয়ে আছে বাবাই।
এই তো সেদিন একটা শক্ত পরীক্ষার আই কিউ টেস্টের অংশটা দেখে ও আনমনে পুরো দু-ঘণ্টার পরীক্ষাপত্র মাত্র কুড়ি মিনিটে শেষ করে ফেলল। কিন্তু পরীক্ষা দিতে ওর ভালো লাগে না। কেন যেন ওর মনে হয় যে পরীক্ষা মানেই একটা বাঁধন। চারদিক থেকে দাগকাটা একটা মাঠ–তার মধ্যে আরও কয়েকজনের সঙ্গে অহেতুক দৌড়। এই দৌড়ই ওর কোনওদিন ভালো লাগেনি। মনে হয় এই দৌড়ই হয়তো বাবাকে কেড়ে নিয়েছে ওর কাছ থেকে। না হলে তো বেশ ছিল লুডোর বোর্ডের দুনিয়া। হার-জিত হয়, কিন্তু বারবার শুরু করা যায় শুরু থেকে।
এত বছর হয়ে গেছে, এখনও বাবার পড়ার ঘরে যেতে ওর খুব খারাপ লাগে। ওঘরে সার দিয়ে বইয়ের আলমারি, নানান ধরনের বই। বাবার ছুটির দিনের অনেকটা সময় জুড়ে থাকত বই। আর ছোট্ট পিকু উঁকিঝুঁকি মারত দরজার ফাঁক দিয়ে। ভারি রাগ হত বইগুলোর ওপর। বাবার সঙ্গে খেলার সময়টা কেড়ে নিচ্ছে ওরা।
বাবা পিকুকে বলত, বুঝলি পিকু, এসব বই তোর জন্য। বড় হয়ে পড়বি। দেখবি এদের জগৎ একেবারে আলাদা। এ জগতে ঢুকতে গেলে শুধু মনের দরজাটা খুলে রাখতে হয়। এরা তখন তোর সঙ্গে কথা বলবে, আর বলে দেবে কীভাবে সত্যিকারের মানুষ হতে হয়।
দাদাবাবু, ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে এ লুডোটা পেলাম–ফেলে দেব? চাকর গণেশের কথায় হুঁশ ফিরল পিকুর।
গণেশ ঘর পরিষ্কার করে। ওকে আজকে বাবার পড়ার ঘরটা পরিষ্কার করতে বলেছিল পিকু।
কই দেখি!
–আলমারির পিছনে পড়ে গিয়েছিল। কী নোংরা যে হয়েছিল ঘরটা!
লুড়োটা হাতে নিয়েই চোখে জল এল পিকুর। কুড়ি বছর আগে কত দিন কেটেছে এই লুডো নিয়ে।
না, ফেলো না। বলে লুডোর পাতা ওলটাল পিকু। সাপলুডোর পাতাটা দেখে মনে হল কতবার দান ফেরত নিত। সাপ পড়লে চলবে না। সিঁড়ি মিস করলে চলবে না। বায়না করে ঠিক আদায় করে নিত। জীবনের সাপলুডোতেও যদি একইভাবে বায়না করে বাবার কয়েকটা দিন আরও আদায় করা যেত!
সাপলুডোর 4 আর 18–ওই নাম্বার দুটোতে ক্ৰশ। লাল পেনসিলের দাগ। লুডোটা হাত থেকে নামিয়েই রাখছিল পিকু, হঠাৎ একটা কথা খেয়াল হতেই প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে পড়ল।
বাবার আমেরিকা যাওয়ার কয়েকদিন আগের কথা। সেদিন বাবা অফিস থেকে ফিরে এসে অফিসের পোশাকেই পিকুর সঙ্গে লুডো খেলছে। হঠাৎ একটা ফোন এল। বাবা উঠে অন্য ঘরে চলে গেল। খানিকবাদে ফিরে এল। সেদিন বাবা বারবার খুব অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল। বারবার পিকুর মাথায় হাত রেখে আদর করছিল। আর স্পষ্ট মনে আছে ওই দুটো বক্সে বাবা পিকুর পেনসিল দিয়ে ক্রস করে বলেছিল, কী বলত এটা পিকু?
তারপর একটু থেমে ভারী গম্ভীর গলায় বলেছিল,–দুটো সাপ–যাদের আমি কখনও ডিঙোতে পারব না।
পিকু তখন সংখ্যা ভালো চিনত না, সাপ চিনত। তাই অদৃশ্য সাপের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল খানিকক্ষণ। আর আজ খুব অবাক লাগছে যে ওই সংখ্যাদুটো পাশাপাশি বসালে যেটা হয় সেটা হল বাবার মৃত্যুদিন। 14 এপ্রিল। 2002 সালের এই দিনেই বাবার এয়ার ক্র্যাশ হয়। এটা শুধুই কোইনসিডেন্স? হঠাৎ করে মিলে যাওয়া?
গ্যারেজ থেকে ওপরে উঠে এল পিকু। সারা বাড়িটাই খুব অগোছালো অবস্থায় আছে। দু-বছর আগে মা মারা যাওয়ার পর থেকেই বাড়িটা গণেশের ওপর থাকে।
ড্রয়িংরুম পেরিয়ে বাবার পড়ার ঘরে ঢুকল পিকু। অনেকদিন এঘরে ঢোকেনি ও। বুককেসের ভেতরে সারি সারি বই। নীচের তাকে বাবার অনেক খাতাপত্র, ফাইল। সময়ের দাগ পড়েছে সেসব কাগজে। লাল হয়ে উঠেছে। বাবা নিয়মিত ডায়েরি ফলো করত। পরপর সাজানো ডায়েরিগুলো। প্রত্যেক বছরের ডায়েরি খুলে ভালো করে দেখল পিকু। নাহ, কিছুই তেমন চোখে পড়ল না।
বাবা মারা যায় ১৪ এপ্রিল 2002। তার কয়েকদিন আগে ডায়েরির পাতায় ডঃ ডেভ জর্ডন বলে একজনের নাম লেখা। অ্যাড্রেসও আছে। অ্যানআবার শহরের ঠিকানা। একটা ফোন নাম্বারও লেখা। কী ভেবে পিকু ওই নাম্বারে ফোন করল। রং নাম্বার, খুবই স্বাভাবিক। কুড়ি বছরে মানুষই পালটে যায়, ফোন নাম্বার তো পালটাবেই।
কাগজপত্রের মধ্যে থেকে পিকুর ছোটবেলাকার একটা ছবি বেরোল। তিন-চার বছর বয়সের ছবি। কবে তোলা কিছু মনে নেই। ফোটোটা বার করে টেবিলের ওপর রাখল পিকু। তারপর কী মনে হতে আবার হাতে তুলে নিল। এটা কি ওরই ছবি! চোখের পাশে কাটা দাগটা কীসের? ওখানে তো কোনওদিন পিকু চোট পায়নি। আর ছবিটা সাদা কালো কেন? ওর সব ছবিই তো কালার্ড। ছোটবেলারও। আর ছবিটা দেখে মনে হয় না ভারতে তোলা। পিছনে সার দিয়ে পাম গাছ।