জয়ন্ত পিকুকে বলল,–এই বাটন প্রেস করলে, 1 থেকে 6 যে-কোনও একটা নাম্বার পড়বে। একবার তুই, একবার ব্রায়ান। যেরকম নাম্বার পড়বে, ঠিক সেরকমভাবে খুঁটি আপনা থেকে বোর্ডের ওপর সরে যাবে। ধর তোর 3 পড়ল, তুই আছিস 42-এ, আপনা থেকে ঘুঁটি 45-এ চলে যাবে। তারপর সিঁড়ি বা সাপ–যেরকম থাকবে ওই ঘরে, সেই অনুযায়ী ঘুঁটি সেখানে। চলে যাবে। কিন্তু হেরে গেলে কোনওরকম বায়না করা চলবে না–ঠিক তো?
পিকু ঘাড় নেড়ে সায় দিল। এ ছাড়া ওর আর কোনও আশাই নেই। ব্রায়ান লাল গুটি নিল। পিকু সবুজ। বরাবরই পিকু সবুজ নিত। খানিকক্ষণের মধ্যেই পিকুর ঘুটি লাফিয়ে লাফিয়ে 90-এর ঘরে উঠে গেল। কিন্তু, তার পরেই 96-এ সাপের মুখে পড়ে একেবারে 17। ব্রায়ানকেও দু-তিনবার সাপে খেল। পিকুকে আরেকবার 98-এর সাপ খেয়ে সোজা পাঠিয়ে দিল 57-এ।
জয়ন্ত পাশে বসে শুধু মুচকি মুচকি হাসছে। আর ওদের ছেলেমানুষি লড়াই দেখছে। প্রোজেক্ট এইচ-এর পরিত্যক্ত হেলিপ্যাডে লড়াই চলেছে দুই ছেলের মধ্যে। ব্রায়ানের মধ্যে কোনও উত্তেজনা নেই। পিকুই মাঝে মাঝে নখ কামড়াচ্ছে। চাল দেওয়ার আগে পায়চারি করে এসে অনির্দিষ্ট কাউকে লক্ষ্য করে কপালে হাত ঠুকে প্রণাম জানিয়ে চাল দিচ্ছে। মাঝে মাঝে সিঁড়ি পেলে লাফিয়ে উঠছে। সাপের মুখে পড়লে রেগে চেঁচিয়ে উঠছে। এটা আজ ওর জীবনমরণের লড়াই। জীবন ফিরে পাওয়ার লড়াই।
কিন্তু আজও ভাগ্য পিকুর সঙ্গে নেই। শেষে ব্রায়ানই জিতে গেল। পিকু মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করল। জয়ন্ত উঠে পিকুকে জড়িয়ে ধরল।
–তুই সত্যিই বড় হোসনি। আরে, সবসময় আমি তোর সঙ্গে থাকব। যেমন ছিলাম। কাছে থাকলেই কি শুধু থাকা হয়? আর ছোঁয়া না গেলেই কি তাকে দেখা যায় না? ওই ওপরের দিকে তাকা। নীল আকাশ–কোনওদিন ছুঁয়ে দেখতে পারবি? কিন্তু সবসময় সঙ্গে থাকে। আমিও সেরকম।
–আসি পিকু। ভালো থাকিস। জড়িয়ে ধরে আবার ছোট বাচ্চার মতো আদর করে পিকুকে জয়ন্ত। ব্রায়ানও এসে জড়িয়ে ধরে পিকুকে। পিঠ চাপড়ে বলে ওঠে, বেটার লাক নেক্সট টাইম। বাবা কিন্তু আমাকেই তোমার থেকে বেশি ভালোবাসেন।
জয়ন্ত আর ব্রায়ান একটা হেলিকপ্টারের দিকে এগিয়ে যায়। ব্রায়ান পাইলটের আসনে বসে। জয়ন্ত অন্য দরজা দিয়ে উঠতে গিয়ে ফের ফিরে আসে। আবার আদর করে জড়িয়ে ধরে। তারপর পিকুর হাতে একটা খাম দিয়ে বলে,–এটা পরে পড়ে দেখিস। মন খারাপ করিস না।
জয়ন্ত ফিরে গিয়ে অন্য দরজা দিয়ে হেলিকপ্টারে ওঠে। ওপরের রোটর ব্লেড চালু হয়েছে হেলিকপ্টারের, মাতালের মতো একটু এদিক-ওদিক করে মাটি ছেড়ে সোজাসুজি বারো তেরো ফুট উঠে গেল হেলিকপ্টারটা। তারপর ছুটে চলল সামনের দিকে। প্রায় আধকিলোমিটার মতো সোজা গিয়ে বাঁক নিয়ে ওপরের দিকে উঠল হেলিকপ্টার। তখনই একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ। আগুনে জ্বলতে জ্বলতে হেলিকপ্টারটা নীচের দিকে নেমে এল।
পিকু পাগলের মতো দৌড়োতে শুরু করল হেলিকপ্টারের দিকে। মাঝে যেন কোনও পথ নেই। পিকুর পুরো দুনিয়াটা আবার দুলিয়ে দিয়ে আরেকবার ওই দিক থেকেই বিস্ফোরণের আওয়াজ এল। হেলিকপ্টারের ছোট ছোট টুকরো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।
বেশ খানিকটা ছুটে হঠাৎ করে বসে পড়ল পিকু। নাহ্, এ ছোটার আর কোনও অর্থ নেই। ওরকম বিস্ফোরণের পরে ওদের কোনওই চিহ্ন থাকবে না।
.
২৪.
দুদিন বাদে সুবীর রায়ের বাড়িতে খামটা খুলেছিল পিকু। ছোট চিঠি।
পিকু, এ চিঠি যখন পড়বি তখন আমি অনেক দূরে চলে গেছি, ব্রায়ানকে সঙ্গে নিয়ে। এ পৃথিবীটা থাকুক সাধারণ মানুষদের জন্য। তাই ব্রায়ানকে সঙ্গে নিয়েই গেলাম। শেষ অতিমানব। আমাকে তো এমনিতে মরতেই হত। এই প্রথমবার লুডোয় তোকে ঠকালাম। এমনভাবে প্রোগ্রাম করা ছিল যে লাল ঘুটি ছাড়া অন্য যে-কোনও ঘুটি নিলেই হারতিস। সেভাবেই সংখ্যাগুলো আসছিল। র্যানডমলি নয়। কি, বোকা বানিয়েছি তো!
থাকগে, আসল কথায় আসি। আমি তো মরতে চাইনি পিকু। তোদের সবাইকে নিয়ে বাঁচতেই চেয়েছিলাম। কিন্তু কি যে হল! হঠাৎ করে একদিন বুঝলাম আমার জীবন আর আমার হাতে নেই। কে যেন হঠাৎ করে আমার সবকিছু কেড়ে নিয়ে আমাকে এক ছোট্ট খাঁচায় বন্দি করে ফেলেছে। সেখানে ভোরের আলো নেই, রাতে তারাজ্বলা আকাশ নেই, সামনে লুডোর বোর্ড নেই, সঙ্গে তোরা নেই। আমি একা। বড় একা।
মন খারাপ করিস না, আমি সবসময় তোর সঙ্গে ছিলাম, থাকবও। আমরা চাঁদের আলোয়, তারার হাসিতে মনে মনে কথা বলব। তোর জন্য একটা ছোট কবিতাও লিখলাম। ছোটবেলায় আমার কবিতা শুনলেই খেপে গিয়ে খিমচে দিতিস। আজ তো সে উপায় নেই। শোনাবই– এ আমারই জীবনের কথাযার সবটুকু জুড়ে তুই।
বন্ধ খামের এপিঠে-ওপিঠে লিখে যাই কিছু কথা।
খামের ভেতরে স্মৃতি হয়ে থাক কিছু প্রিয় নীরবতা।
(গল্পে উল্লিখিত সব চরিত্র কাল্পনিক)