মিনিট দশেক পরে ওদের গাড়ি একটা একতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। বিল্ডিংটার ওপরে লেখা ম্যাভেরিক ফ্লাইং ক্লাব।
গাড়িটা পার্কিং-এ রাখার সময় পিকু দেখল বাড়িটার পেছনে বড় হেলিপ্যাড। বেশ কয়েকটা হেলিকপ্টার দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। ওরা বাড়ির মধ্যে না ঢুকে পাশের রাস্তা দিয়ে। সরাসরি হেলিপ্যাডে চলে এল। বাড়িটার পিছন দিকে হেলিপ্যাডের আগেই একটা গোল টেবিল পাতা। তাতে তিনটে চেয়ার। একটা চেয়ারে অন্যদিকে মুখ করে একজন বসে আছে। বড় গোল টেবিলটার ওপরে একটা কাঠের বাক্স রাখা।
–ডঃ কেন, আমরা এসে গেছি। ব্রায়ান দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল টেবিলটার দিকে।
পিকুও দ্রুত পায়ে ব্রায়ানের পিছু পিছু হাঁটছিল, কিন্তু হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। মনে হল, পরিচিত গলায় ডঃ কেন যেন মৃদুস্বরে গাইছেন, সুখহীন নিশিদিন পরাধীন হয়ে। ভ্ৰমিছ দীনপ্রাণে সতত হায় ভাবনা শতশত, নিয়ত ভীতপীড়িত…
ব্রায়ান ফের বলল,ডঃ কেন, আমি আর পিকু এসে গেছি। গান থামিয়ে ডঃ কেনও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন।
–বাবাই। পিকু চিৎকার করে উঠল। ছুটে এগিয়ে গেল ডঃ কেনের দিকে। তারপর। দাঁড়িয়ে পড়ল। অভিমানে চোখ ফেটে জল আসছে। এতদিন বাবাই ওকে ছেড়ে থাকতে পেরেছে। যাকে গত কুড়িবছর ধরে প্রতি মুহূর্তে পিকু খুঁজেছে, সে খোঁজা অর্থহীন জেনেও–সেই বাবাই সশরীরে চোখের সামনে দাঁড়িয়ে? এত নিরুত্তাপ হয়ে?
কান্না আর থামিয়ে রাখতে পারল না পিকু। সে কান্না আনন্দের, না দুঃখের, না অভিমানের কে জানে? জয়ন্ত এগিয়ে এসে বুকে জড়িয়ে ধরল পিকুকে। জয়ন্তর চোখেও জল। খানিকবাদে ধরা গলায় বলে উঠল,–কেমন আছিস রে অদ্ভুত! অনেক বড় হয়ে গেছিস।
পিকু ছোটবেলায় ভূতের নামে খুব ভয় পেত বলে, ওকে মজা করে জয়ন্ত মাঝেমধ্যে অদ্ভুত বলে ডাকত। বলত ওই নাম শুনলে, ভূতেরা পালায়।
চেয়ারে বসে জয়ন্ত বলল,আমার উপায় ছিল না রে! আমেরিকার সরকার ওদের প্রোজেক্টে আমার সাহায্য পেতে আমার বিরুদ্ধে টেররিজমের চার্জ এনেছিল। যাতে আমি ওদের সাহায্য করতে বাধ্য হই। রিপোর্টে প্রকাশ না করলেও প্লেনে বিস্ফোরণের জন্য আমাকেই দায়ী করেছিল। তা ছাড়া আমিও তো ছিলাম ওই তিরিশজন যাত্রীর একজন। তাই প্লেনে না উঠেও চিরকালের মতো হারিয়ে গেল জয়ন্ত। আমাকে নিয়ে আসা হল এখানে যেখান থেকে কারুর পক্ষেই আর বেরোনো সম্ভব নয়।
পিকু অভিমানী গলায় বলে উঠল, মা মারা গেছে দু-বছর আগে। আমার মতো মার জীবনও শেষ হয়ে গিয়েছিল তোমার হঠাৎ চলে যাওয়ায়।
জয়ন্ত চুপ করে রইল খানিকক্ষণ। তারপর বলল, আমার পক্ষে কিছু জানা সম্ভব ছিল না। যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তোরাও রেহাই পেতিস না। তাও যে একেবারে চেষ্টা করিনি তা নয়। খুব মন খারাপ লাগলে তোদের বাড়িতে ফোন করে রিং হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে কেটে দিতাম। ওরা বলেই রেখেছিল কোনওভাবে তোরা খবরটা পেলে তোদেরকে মারতে ওরা একমুহূর্তও দ্বিধা করবে না। গত কুড়ি বছর আমার এখানেই কেটেছে প্রোজেক্ট এইচ-এ। দুদিন আগেই প্রোজেক্ট এইচ বন্ধ হয়ে গেছে। তবে আমাকে ওরা আজও ছাড়বে না, সব খবর তাহলে বাইরে চলে যাবে।
পিকু বাবাই-এর মুখের দিকে তাকাল। চুল সব পেকে গেছে। মুখে বয়সের সামান্য ছাপ পড়লেও চোখের সেই দীপ্তি, মুখের স্মিত হাসি এতটুকুও ম্লান হয়নি।
বাবার হাতটা চেপে ধরল পিকু,–এবার তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবই বাবাই। পেয়েছি যখন সারা পৃথিবীর সঙ্গে লড়তে হলেও লড়ব। কিন্তু তোমাকে কোনওভাবেই ছাড়ব না। সেরকম হলে আমিও এখানেই থেকে যাব। ওখানেই বা আমার কে আছে?
জয়ন্ত হেসে উঠল। বুঝতে পারল ছোটবেলার সেই জেদ-বায়না আজও পিকুর মধ্যে একইভাবে রয়ে গেছে।
জয়ন্ত বলল,আমাকে যে আবার একটা জরুরি কাজে ফিরতে হবে সোনা, সেখানে শুধু একজনই আমার সঙ্গে যেতে পারবে, তা কাকে নেব? তোকে না ব্রায়ানকে?
–আমাকে বাবাই! জোরে চিৎকার করে উঠল পিকু। পাশে দাঁড়িয়ে পিকুর ছেলেমানুষি দেখে মিটিমিটি হাসছে ব্রায়ান।
জয়ন্ত বলে উঠল, ব্রায়ান তোর ভাই। সেটা করলে ওর প্রতি অন্যায় হয়ে যাবে।
তাহলে আমরা দুজনেই যাব।
না, তা তো হয় না। বললাম না। একজনই শুধু সঙ্গে যেতে পারবে। তার থেকে। আমরা অন্যভাবে ডিসাইড করব। তোদের দুজনের মধ্যে চেস হোক তাহলে। যে জিতবে, সে যাবে।
পিকু খুব উৎসাহিত হয়ে লাফিয়ে উঠল, হ্যাঁ, চেস। চেসেই তাহলে ঠিক হবে।
জয়ন্ত হেসে উঠল, তুই আমার মতোই হয়েছিস বটে। ছেলেমানুষি আর গেল না। খেল, তবে শুধু এটা বলে রাখি–তুই যার কাছে হেরেছিস সেই ড্যানিয়েলকে ব্রায়ান প্রত্যেকবার। হেসে খেলে হারায়। তারপরেও?
একটু চিন্তায় পড়ে গেল পিকু,–তাহলে দৌড়? আমি দৌড়ে খুব ভালো।
ফের হেসে উঠল জয়ন্ত,–পাগল হয়েছিস? ব্রায়ান ঠিক তোর মতো হলেও ও সুপারহিউম্যান। ওকে আমি চিতাবাঘের স্পিড় দিয়েছি আর বাঘের শক্তি দিয়েছি–যাতে তোর বিপদে ও কাজে লাগে। তুই পারবি ওর সঙ্গে?
পিকু কাঁদো কাঁদো গলায় এবার বলে উঠল, কিন্তু আমি যাবই। বলো কী করলে পারব? অসহায় ভাবে ব্রায়ানের দিকে আড়চোখে তাকাল পিকু। ব্রায়ান এখনও মুচকি মুচকি হাসছে।
লুডো! লুডো খেলবি? পিওর লাক। যে জিতবে সেই সঙ্গে যাবে আমার। বোর্ডও আছে সঙ্গে। বলে টেবিলের ওপরে রাখা বাক্সটা খুলে ফেলল জয়ন্ত। বড় লুডোর বোর্ড। পুরোটা ডিজিটাল। কিন্তু ছক্কা নেই। দুদিকে ডিজিটাল প্যানেল, তাতে দুদিকে বাটন।