লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল পিকু। নীলচে চোখ, সোনালি আঁকড়া চুল অনেকটাই সেই চেস চ্যাম্পিয়ান ড্যানিয়েলের মতো দেখতে, মুখটা আরেকটু বেশি লম্বা। চোখের নীচটা বসা মতো।
–আমি ড্যানিয়েলের বন্ধু। বলে ডান হাতটা বিদ্যুৎবেগে বাড়িয়ে একহাতেই গলা টিপে ধরল পিকুর। দুহাত দিয়ে ওই লোহার মতো শক্ত হাত প্রাণপণে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল। পিকু। কিন্তু শক্ত লোহার মতো আঙুলগুলো সাঁড়াশির মতো গলার ওপরে চেপে বসেছে। ছটফট করতে লাগল পিকু। চোখে অন্ধকার দেখতে লাগল। বুঝতে পারল মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে।
এরমধ্যে হঠাৎ কাঁচ ভাঙার শব্দ। কেউ পিকুর গলা থেকে ওই দৈত্যটার হাত টেনে সরিয়ে দিল, দৈত্যটার মুখে একটা জোরালো ঘুসি মারল। গাড়ির দরজাটা উপড়ে খুলে নিয়ে দৈত্যটাকে গাড়ি থেকে টেনে বের করে নিল।
পিকু টের পেল এখুনি আসা লোকটার সঙ্গে ট্যাক্সি ড্রাইভারের প্রচণ্ড মারামারি শুরু হয়েছে। দুজনের কেউই কম যায় না। গাড়ি থেকে কোনওরকমে হাতে ভর দিয়ে বেরিয়ে এসে খোলা বাতাসে নিশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করল পিকু। কিন্তু পারল না, ওখানেই বসে পড়ল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারাল।
জ্ঞান যখন ফিরে এল মুখের সামনে চাঁদের আলোয় এক চির পরিচিত মুখ। নিজেরই মুখ। অর্থাৎ এ আর কেউ নয় ব্রায়ান। পিকুকে চোখ খুলতে দেখে ব্রায়ান বলল,এখন কেমন লাগছে? ও হল ড্যানিয়েলের বন্ধু–যার কথা বলছিলাম। এখান অবধি কীভাবে জানি ফলো করে চলে এসেছিল। নির্ঘাত এই ট্যাক্সির ড্রাইভারকে মেরে ড্রাইভার সেজে উঠে বসেছিল। ইশ, তোমার কিছু হলে ডঃ কেনকে যে কী বলতাম!
আস্তে আস্তে বাইরের পৃথিবীর মায়াবী আলো ফিরে আসছে। চাঁদটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আর তার আলোয় পিকু দেখল, ব্রায়ানের মুখটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে, জামা রক্তে লাল হয়ে গেছে। খানিকদূরে ড্যানিয়েলের বন্ধুর দেহ পড়ে আছে।
নাক-মুখের রক্ত রুমাল দিয়ে মুছতে মুছতে ব্রায়ান বলে উঠল,–আমি ঠিক আছি। আর কয়েক সেকেন্ড দেরি হলে যে কী হত! চলো গাড়িতে ওঠা যাক! আর ভয় নেই। আমি আছি তো!
বলে পিকুকে পাঁজাকোলা করে তুলে গাড়ির পিছনের সিটে সস্নেহে শুইয়ে দিল ব্রায়ান। গাড়ির একদিকের দরজার পাল্লাটা না থাকায় শুতে কোনওই অসুবিধে হল না পিকুর। টের পেল ব্রায়ান গাড়ি স্টার্ট করেছে।
.
২২.
রাত দুটো। ডক্টর কেনের চোখে আজ ঘুম আসছে না। হঠাৎ সেলফোনটা বেজে উঠল। হাত বাড়িয়ে খাটের পাশে রাখা ফোনটা ধরলেন কেন।
–ডক্টর কেন, আমি ব্রায়ান বলছি।
–হ্যাঁ, বলো। তুমি পাম স্প্রিং পৌঁছে গেছো তো?
–হ্যাঁ, আমি পাম স্প্রিং-এ।
–তা এত রাতে?
–আমি পিকুকে নিয়ে আসতে পেরেছি। একটু অসুবিধে হয়েছিল।
কী?
–রজার পিকুকে আক্রমণ করেছিল। তাই রজারকে মারতে হয়েছে আমাকে।
–তাই? দীর্ঘশ্বাস পড়ল ডঃ কেন-এর। পিকু ঠিক আছে তো?
–হ্যাঁ।
–আর তুমি?
একটু যেন উৎসাহিত হল ব্রায়ান। হ্যাঁ, আমার একটু লেগেছে, মাথায় আর মুখে। ও তেমন কিছু না। স্যার, যে জন্য ফোন করেছিলাম–একটু থামল ব্রায়ান।
স্যার, আমাকে কি তৈরিই করা হয়েছে আমার ভাইকে বাঁচানোর জন্য?
–হ্যাঁ, তা হঠাৎ এরকম প্রশ্ন?
–কেন? ও তো আমার মতোই। ওর জীবন তাহলে আমার থেকে বেশি দামি কেন?
ডক্টর কেন কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। শুধু বলে উঠলেন,–শুয়ে পড়ো ব্রায়ান। কাল কথা হবে। তোমাকে আমার সঙ্গে অনেক দূর যেতে হবে।
–আর পিকু?
নাহ্, ওকে নেব না। তুমিই থাকবে আমার সঙ্গে।
ব্রায়ান ভারি খুশি হয়ে শুভরাত্রি স্যার বলে ফোনটা রেখে দিল।
.
২৩.
আজকের ভোরটা একদম অন্যরকম। সূর্য ওঠার আগেই যেন ভোর হয়ে গেছে। রাত কাটার আগেই যেন দিন শুরু। সারারাত বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে পিকু। যন্ত্রণায় নয়, কৌতূহলে আর উত্তেজনায়। কার সঙ্গে কাল দেখা হতে চলেছে? ডঃ কেন–যার কথা ব্রায়ান একবার বলেছিল?
ডঃ কেন কি বাবার কথা জানতেন? পাম স্প্রিংস-এর মতো মরুভূমির মধ্যে এক জনহীন শহরে কী থাকতে পারে? সত্যিই কি সত্যের সন্ধান পেতে চলেছে পিকু? কুড়ি বছর আগে পিকুর জীবনের রূপ-রস-গন্ধ সবকিছু একমুহূর্তে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল যে ঘটনা, সেই ঘটনাটার পিছনে আসলে কে ছিল? সেই খারাপ লোকগুলোর সঙ্গে কি মোলাকাত হবে এবার?
এসব ভাবতে-ভাবতেই রাত শেষ হয়ে গেছে। হামাগুড়ি দিয়ে ঘরে ঢুকেছে ভোরের ক্ষীণ আলো। ব্যর্থ ঘুমটাকে ফের ডেকে না এনে সাড়ে চারটে থেকেই রেডি হয়ে রয়েছে পিকু। কথামতো ঠিক সাড়ে পাঁচটাতে ব্রায়ান এসে হাজির। পিকু হোটেলের গেটের সামনে অপেক্ষা করছিল।
গাড়িতে উঠে ব্রায়ানের দিকে তাকাল পিকু। সারা মুখে কালসিটে কাটা দাগ। ড্যানিয়েলের বন্ধু যে খুব সহজে ছেড়ে দেয়নি তার প্রমাণ ব্রায়ানের শরীরের সর্বত্র। তবু তা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ব্রায়ান বলে উঠল,–দুর্দান্ত ঘুম হল কাল। অত পরিশ্রম হয়েছিল তো! তা তোমার রেস্ট হল কেমন? দেখে তো মনে হয় না ঘুমিয়েছ।
পিকু সায় দিল,–তা কোথায় যাচ্ছি? কার সঙ্গে দেখা করতে?
হেসে উঠে ব্রায়ান বলল,আর তো মিনিট দশেকের অপেক্ষা। তারপর সব প্রশ্নের জবাব পাবে।
তুমি ডাক্তার দেখিয়েছ? কাল আমার জন্য যা করলে!
হেসে উঠল ব্রায়ান। খুব সহজভাবে বলল,আমার জন্ম-মৃত্যু সবই তো তোমার জন্য তোমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। বলে পিকুর দিকে তাকাল। ব্রায়ানের গভীর দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে পিকু বুঝল যে ও কথাটা হালকাভাবে বলছে না।