সুবীরবাবুর কথাই ঠিক। ডিটেকটিভ আবার ফিরে এসে খুব গম্ভীরভাবে পিকুকে জিগ্যেস করল,–খেলার শেষে তোমাদের মধ্যে কি মারপিট বা ঝগড়া হয়েছিল?
পিকু হেসে বলল, না, না। আমরা চেস খেলছিলাম, আমেরিকান ফুটবল বা রাগবি নয়।
ডিটেকটিভ কী বুঝল কে জানে? এবার পুরো দলবল নিয়ে চলে গেল আশেপাশে খোঁজ নিতে–কেউ কোনও সন্দেহজনক কিছু দেখেছে কিনা। গেটের কাছে একজনকে আর ক্রাইমের জায়গাটায় আরেকজনকে দাঁড় করিয়ে চলে গেল।
এরমধ্যে সুবীরবাবুর ফোন বেজে উঠল। সাইমনের ফোন। সেই মিসিগান লস্কুলের লাইব্রেরিয়ান–যার সঙ্গে চেস টুর্নামেন্টের দিন দেখা হয়েছিল, যিনি পিকুকে জড়িয়ে ধরে তিনমিনিট কেঁদেছিলেন।
একবার গেটে আসবেন? আপনার গেটে যে গাধাটি দাঁড়িয়ে আছে, সেটি আমাকে ঢুকতে দিচ্ছে না।
–আরে আপনি! আমি এক্ষুনি আসছি।
গেটের কাছে ভদ্রলোকের সাদা মার্সেডিজ গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। উনি ড্রাইভারের সিটে বসে হাত নাড়ছেন। সুবীরবাবু বলার পর রোবট পুলিশ সাইমনকে ঢুকতে দিল। গাড়ি সোজা গ্যারেজে ঢুকিয়ে ভদ্রলোক গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন।
সুবীরবাবুর কৌতূহলী মুখের দিকে তাকিয়ে গ্যারেজ থেকে বাড়িতে ঢোকার দরজা দেখিয়ে বলে উঠলেন, সব জানি। ভেতরে ঢুকে বলছি।
ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বলে উঠলেন, পিকু, তুমি দু মিনিটের মধ্যেই রেডি হয়ে বেরিয়ে যাও। তোমার খুব বড় বিপদ। রাস্তায় কুড়ি ফুট অন্তর ক্যামেরা রাখা আছে। পুলিশ ওইসব ক্যামেরার ছবি চেক করছে। এ রাস্তা দিয়ে গত তিনঘণ্টায় যত গাড়ি গেছে, সব গাড়ি ও গাড়ির ভেতরের লোকেদের ছবি–ওই সব ক্যামেরায় তোলা আছে। এই সময় এমনিতেও খুব কম গাড়ি যায়, তাই খুঁটিয়ে দেখছে ওরা।
–তাতে কী?
–তাতে পিকুর ছবি আছে।
-মানে? সে তো আমরা পরশু মাঝরাতে একটা জায়গা থেকে ফিরছিলাম বলে। আমিও তো ছিলাম গাড়িতে। সুবীরবাবু বললেন।
তা নয়। ঠিক পিকুরই মতো দেখতে আরেকজন আছে। তার ছবিই ধরা পড়েছে ক্যামেরাতে। তার হাতেই খুন হয়েছে ওই ছেলেটা। যে মারা গেছে তার নাম ড্যানিয়েল। পরশু দিনই আমি আপনাদেরকে ড্যানিয়েল সম্পর্কে বলতাম। ও কাছাকাছি ছিল বলে বলিনি। ড্যানিয়েল ঠিক সাধারণ মানুষ ছিল না, ও ছিল অনেক স্পেশাল ক্ষমতার অধিকারী। ও আর ওর বন্ধু থাকত আমার পাশের বাড়িতে। তাই আমি ওদের দুজনের সম্পর্কেই খানিকটা জানতাম।
একটু থেমে পিকুর দিকে তাকিয়ে সাইমন বলে উঠলেন,–আমি সেদিন শুধু শুধু অতটা কঁদিনি। তোমার বাবা ছিলেন আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ও মিসিগান মেডিক্যাল স্কুলে বায়োমেডিক্যাল সায়েন্স রিসার্চ বিল্ডিং-এ রিসার্চ করত। আমরা প্রায়ই বসে দাবা খেলতাম। আগে আমি বলিনি, কারণ ড্যানিয়েল অনেক দূর থেকেও সব কথা শুনতে পায়। দেখতে পায়। টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই ও তোমাকে বিশেষভাবে লক্ষ করছিল। ওর দৃষ্টিতে তোমার ওপর একটা আক্রোশ ছিল–সেটা আমার চোখ এড়ায়নি।
–দুদিন আগে আমি জুলি জর্ডনের বাড়ি গিয়েছিলাম, ওখানে ওকেই আমি দেখেছিলাম, আমার মনে হয় ও আমাকে দেখেছিল। পিকু ফের বলে, পরশুদিন ও আমার অ্যাড্রেস-ও নিয়েছিল।
–হ্যাঁ, তাই হবে। জুলিকে আমিও চিনতাম, কারণ ওর হাজব্যান্ড ডেভের সঙ্গে আমার। পরিচয় ছিল। কাল মাঝরাতে ড্যানিয়েলকে আমি বেরোতে দেখি। ওর হাতের বন্দুকটা আমার চোখে পড়েছিল। কেন জানি না, তোমার কথাই মনে হয়েছিল। একটু দূরে দূরে থেকে ফলো করছিলাম। গাড়িটা একটু দূরে রেখে তোমাদের পিছন দিকে যে বাড়িটা আছে, দেখলাম, তার মধ্যে দিয়ে তোমাদের বাড়ির দিকে এগোচ্ছে। ঠিক এর মধ্যে আরেকজনকে দেখলাম ওর পিছু নিতে। অন্ধকারে তাকে আমি অবশ্য ভালো করে দেখতে পাইনি।
ঠিক করলাম ওখানেই অপেক্ষা করব। মিনিট পাঁচেক কেটে গেল। হঠাৎ একটা আওয়াজ পেলাম তোমাদের বাগানের দিক থেকে। যাব কি যাব না ভাবছি, দেখলাম পিকু তোমাদের পেছনের বাড়ির বাগান থেকে জোরে হেঁটে বেরিয়ে আসছে।
আমি স্বাভাবিক ভাবেই ওর দিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম। ছেলেটা বলে উঠল, আমি পিকু নই, পিকুকে এক্ষুনি অ্যান আবার ছেড়ে চলে যেতে বলুন।
বলে পকেট থেকে একটা খাম বার করে এগিয়ে দিল। একটা গাড়ি দেখিয়ে বলে উঠল, আমি ওর জন্য এখানেই অপেক্ষা করছি। ওর বড় বিপদ।
এটা আধঘণ্টা আগের কথা। পুলিশ এসে যাওয়ায় আমি আগে বলতে পারিনি।
–কিন্তু কোথা দিয়ে বেরোব? গেটে তো পুলিশ আছে।
–আরে সে তো সামনের গেটে। তুমি এই পেছনের বাগান পেরিয়ে পেছনের বাড়ির মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলে যাও।
–কিন্তু ছেলেটা কে?
–ছেলেটা তোমার যমজ ভাই। তুমি নিশ্চিন্তে ওর সঙ্গে যেতে পারো। ও তোমাকে বাঁচাতেই এসেছে, জয়ন্ত আমার খুব বন্ধু ছিল বলেই ব্যাপারটা জানি। শান্তনু, অর্থাৎ তোমার দাদা মারা যাওয়ার পর ওর ডিএনএ দিয়ে দুজন যমজ সন্তানের পরিকল্পনা করেছিল জয়ন্ত। একজন হলে তুমি। অন্যজন নির্ঘাত ওই ছেলেটা। যাও পিকু, আর একমুহূর্তও দেরি কোরো না।
পিকু ব্যাগ নিয়ে পাঁচ মিনিটে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। সাইমনের কথামতো বাড়ির পিছন দিক দিয়ে অন্য বাড়ির বাগান পেরিয়ে পিছনের রাস্তায় গিয়ে নামল। বাইরে এখন ভালো আলো। সূর্যোদয় হয়ে গেছে। একটা কালো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতেই দরজা খুলে গেল।