প্রোজেক্ট ডাইরেক্টর ডঃ কোলিন খানিক আগেই ওপরতলার আদেশ শুনিয়েছেন। উনি প্রতিরোধের যাবতীয় চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু আদেশের কোনও নড়চড় হয়নি। আজকের মধ্যেই এ কাজ সারতে হবে। এ ল্যাবও বন্ধ করে দিতে হবে।
ঝাপসা চোখে বিল্ডিংটা একবার শেষবারের মতো পর্যবেক্ষণে বেরোলেন ডঃ কেন। চারতলা। বেসমেন্টে নানান ধরনের জন্তু রাখা। চিতাবাঘ থেকে গিরগিটি। ইঁদুর থেকে র্যাটল স্নেক। এদের থেকে ডিএনএ নিয়ে নানান ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়। এদের ওপরেও অনেক টেস্ট হয়। এর পাশেই বিশাল অপারেশন থিয়েটার। বিশাল স্টেনলেস স্টিলের ফার্মেন্টর, সাইক্লোট্রন–জিন পরিবর্তনে যে রেডিয়ো অ্যাকটিভ কণা লাগে তার জন্য।
একতলায় NMR স্ক্যানার। PET স্ক্যানার। অত্যাধুনিক মাইক্রোবায়োলজি ল্যাব। ডঃ কেনের নিজের হাতে খুব যত্নে তৈরি করা। দোতলায় বিশাল ল্যাবরেটরি–এখানেই জিনের গঠন পালটানোর নানান ধরনের যন্ত্রপাতি। তিনতলায় লাইব্রেরি। সার দিয়ে কম্পিউটার রাখা আছে। অফিস এরিয়া। বিশাল অডিটোরিয়াম।
ধীরপায়ে পুরো অফিসটা ঘুরে ডঃ কেন অডিটোরিয়ামে ঢুকলেন। ওনার তৈরি সব অতিমানবকে উনি অডিটোরিয়ামে আসতে বলেছেন দু-ঘণ্টা বাদে। এখন অবধি কেউ কিছু জানে না। আর দু-ঘণ্টা বাদে এই অডিটোরিয়ামই হবে ওদের বধ্যভূমি। ওদের প্রত্যেককে ইঞ্জেকশন দিতে হবে। কৃত্রিমভাবে তৈরি ক্ষতিকারক ভাইরাসের ডিএনএ এদের ক্রোমোজোমে মিশে যাবে। তারপর আর কতক্ষণ?
মুখে হাত চাপা দিয়ে অন্ধকার অডিটোরিয়ামের প্রথম সারিতে বসে গেলেন ডঃ কেন। কান্নায় ভেঙে পড়লেন। এদের কী বলবেন? তোমাদের জীবন আমিই দিয়েছি, আজকে সে জীবন আমিই আবার কেড়ে নেব।
তিলতিল করে যত্নে গড়ে তোলা এই প্রাণগুলোকে কালকের ভোর কোনওভাবেই দেখতে দেওয়া যাবে না। আর ওরা? ডঃ কেন জানেন যে ওরা এর কোনও প্রতিবাদ করবে না। ওদের কাছে একটাই পৃথিবী–একটাই সূর্য–একটাই ঈশ্বর–একজনই শেষ কথা–তিনি হলেন ডঃ কেন। সেরা সৈনিকদের মতো হাসিমুখে মৃত্যুও মেনে নেবে আদেশ পেলে।
কতক্ষণ এভাবে কাঁদছিলেন কে জানে? বাইরের বন্ধ দরজায় টোকা পড়ছে। ল্যাবের টিম ইঞ্জেকশন রেডি করে এসে গেছে। প্রথম সারির চেয়ার থেকে দরজার দিকে হেঁটে এগিয়ে গেলেন ডঃ কেন। মাঝের কুড়ি ফুটকে ওনার মনে হল যেন কুড়ি বছর পেছনে হাঁটা।
স্পষ্ট কানে ভাসছে অনেকগুলো বাচ্চার কান্না। প্রথম ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়েছে ওদের ছোট ছোট শরীরে, হাতে-পায়ে। আর তাদের গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন উনি। না, এরা তো শুধু নিজের সৃষ্টি নয়–কোনও এক্সপ্রেরিমেন্টের ফসল নয়–এরা তো ডঃ কেনেরই সন্তান। মনে মনে ডঃ কেন তখনই স্থির করেছিলেন সুখে-দুঃখে সবসময় এদের সঙ্গে থাকবেন উনি। বাবা-মার আরও নানান পরিচয়ের শূন্যস্থানগুলো একাই পূরণ করবেন উনি। আর আজকে? আজকে সে প্রতিজ্ঞা ভাঙতে হবে–খুনি হতে হবে। ওরা যখন ছটফট করবে যন্ত্রণায়, তখনও মনকে বোঝাতে হবে–যা এতদিন ভেবেছি সব মিথ্যা সব অহেতুক প্রশ্রয়। এরা সন্তান নয়– কেউ নয়। বিজ্ঞানীর জীবনে সত্য শুধু একটাই বিজ্ঞান।
.
১৯.
স্যার, ওরা সব অডিটোরিয়ামে এসে বসেছে। আমাদের মেডিকাল টিমও রেডি। আপনি কি একবার ওদের সঙ্গে কথা বলবেন? শেষবার?
শেষবার কথাটা খুব কানে লাগল ডঃ কেনের। না–বিরক্ত হয়ে স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে জোরে চেঁচিয়ে উঠলেন ডঃ কেন। তারপর কি ভেবে আবার উঠে দাঁড়ালেন। বলে উঠলেন– চলো।
খানিক আগে অডিটোরিয়াম ছেড়ে চলে এসেছিলেন। মেডিকাল টিমের প্রস্তুতি–একবার দেখে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। এসে বসেছিলেন ওনার চেম্বারে–তখন ওদের কেউ ছিল না।
ধীরপায়ে ডঃ কেন এগিয়ে চললেন অডিটোরিয়ামের দিকে। সঙ্গে জুনিয়র সায়েন্টিস্ট ডক্টর রজার। ঢোকার সঙ্গে-সঙ্গেই পরিচিত সমবেত কণ্ঠ–গুড মর্নিং ডক্টর কেন। অন্যদিনের মতো একইভাবে ফিরতি গুডমর্নিং–বলতে গিয়ে আওয়াজ বেরোল না ডঃ কেনের। ডায়াসের ওপর উঠে নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বলতে শুরু করলেন–
–আমি সরাসরি আসল কথায় চলে আসি। তোমরা হয়তো আগেই খানিকটা আন্দাজ পেয়েছ। হা–আজকেই তোমাদের শেষ দিন। খানিকক্ষণের মধ্যেই তোমাদের ইঞ্জেকশন দেওয়া হবে। আর তার দশমিনিটের মধ্যেই তোমাদের মৃত্যু হবে। যন্ত্রণা খুব একটা হবে না হলেও তা সহ্য করার শক্তি তোমাদের আছে। ইঞ্জেকশন দেওয়ার সময় তোমরা মেডিকাল টিমের সঙ্গে সবরকম সহযোগিতা করো। কারও কোনও প্রশ্ন আছে?
পুরো অডিটোরিয়ামে পিন ড্রপ সাইলেন্স। একেই বলে ট্রেনিং। একেই বলে শৃঙ্খলাবোধ। এদের কি আর কষ্ট হচ্ছে না! এ জীবনের প্রলোভন কাটানো বড় শক্ত। সেই আবেগ-অনুভূতিকে সহ্য করার ট্রেনিং পেয়েছে এরা! কিন্তু ডক্টর কেন তো আর এদের মতো ট্রেনিং নেওয়া সেনা নন। তাই এই নীরবতা ওনার সহ্য হল না। উনি ফের বলে উঠলেন,আমি তোমাদের খুব ভালোবাসি। তোমরাই ছিলে আমার সবথেকে আপনার। তোমাদের প্রত্যেককে আমি আমার সন্তানের মতো দেখেছি। কিন্তু এই মুহূর্তে এটাই আমার আদেশ। আরেকবার জিগ্যেস করছি– কারও কোনও প্রশ্ন আছে? ধরা গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন।
একটা হাত উঠেছে। কোলিন। ডক্টর কেন সবাইকে সমানভাবে ভালোবাসার চেষ্টা করলেও, যাদেরকে একটু বেশি ভালোবাসতেন, তাদের মধ্যে কোলিন একজন। খুব শান্ত-বাধ্য ছোটবেলা থেকেই। ছোটবেলায় মাঝেমধ্যেই পালিয়ে ডক্টর কেনের ঘরে চলে আসত। আর ডক্টর কেনের গা ঘেঁষে বসে মুগ্ধ দৃষ্টিতে ডক্টর কেন কি করেন তা লক্ষ্য করত। হাজারো প্রশ্ন করত। কখনও-বা রাতে ভয় পেয়ে ডক্টর কেনের চাদরের মধ্যে ঢুকে ডক্টর কেনকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ত।