বলে ছেলেটা একটা ছোট কাগজে ওর নাম্বার আর ঠিকানা দিয়ে বলে উঠল,–একবার ফোন করে চলে আসবে। এখান থেকে খুব কাছেই। পিকুও ওর ঠিকানা কাগজে লিখে দিল। হ্যান্ডশেক করে এবারে ছেলেটা ওর গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
গাড়িতে উঠেই সুবীরবাবু বলে উঠলেন কি সাংঘাতিক ছেলে রে বাবা ড্যানিয়েল! চাল দিচ্ছিল কি স্পিডে! তুমি ছাড়া আর কেউ দু-মিনিটও টিকতে পারেনি। এক একবার সাইমনের দিক থেকে চোখ সরাই, দেখি ছেলেটা আরেকজনের সঙ্গে খেলতে বসে গেছে। যারা ভালো হয়, সবেতে ভালো হয়।
পিকু যেন শুনে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল। কোথাও কি দেখেছে আগে ছেলেটাকে? একবার জুলির সঙ্গে কথা বলা দরকার।
ও সুবীরবাবুকে বলল,আচ্ছা, মিসেস জুলিকে একবার ফোন করে দেখবেন–কোনও খবর পেয়েছেন কিনা। কাল যখন কথা হল তখন উনি বলেছিলেন যে উনি চেনাজানার মাধ্যমে আপিল করবেন এয়ারক্র্যাশ ইনভেস্টিগেশন ফের চালু করার জন্য।
–হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। একবার ফোন করে দেখি। গাড়ির ড্যাশবোর্ড থেকে জুলির নাম্বার ডায়াল করলেন সুবীরবাবু। ফোনটা অনেকক্ষণ রিং হয়ে গেল। খানিকক্ষণ বাদ দিয়ে আবার ডায়াল করলেন। ফের অনেকক্ষণ রিং হয়ে গেল।
–এত তাড়াতাড়ি তো শুয়ে পড়ার কথা নয়। একবার ওনার বাড়িতে যাওয়া যাবে? পিকু বলে উঠল।
–এখন? রাত নটার সময়?
–হ্যাঁ, গিয়েই দেখা যাক না! আমার মনে হচ্ছে ওনার কিছু বিপদ হয়েছে।
ওরা সুবীরবাবুর বাড়ির প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছিল। সুবীরবাবু গাড়ি ঘোরালেন। যখন জর্ডনদের বাড়িতে ওরা পৌঁছোল তখন রাত প্রায় দশটা। বাগানের কয়েকটা আলো জ্বলছে, তবে পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় তারা ম্রিয়মান। চারদিকে অনাদরে বেড়ে ওঠা গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে বাড়িটাকে দেখলে কেমন রোমাঞ্চ হয়। মনে হয় জীবনের চঞ্চলতা থেকে বহুদূরে একা যেন দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির ভেতরে আলো জ্বলছে। বেল বাজাল ওরা।
আগের দিনও ওনার দরজা খুলতে দেরি হয়েছিল। কিন্তু আজ প্রায় দশমিনিট কেটে গেল। বারবার বেল বাজানো সত্ত্বেও কোনও উত্তর নেই। তাহলে কি জুলি বেরিয়েছেন? কিন্তু। গাড়ি তো গ্যারেজেই! জুলি সেলফোনেও সাড়া দিচ্ছেন না।
বাধ্য হয়ে 911 ডায়াল করলেন সুবীরবাবু। পাঁচমিনিটের মধ্যেই পুলিশ এসে গেল। দরজা খুলে পুলিশের সঙ্গে সঙ্গে ঢুকে পড়ল ওরা।
জুলি রিক্লাইনারে হেলান দিয়ে নিস্পন্দভাবে বসে আছেন। মুখটা একদিকে কাত। দেখেই বোঝা যায় প্রাণ নেই। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুল্যান্স এসে গেল। ওখানেই ডাক্তাররা ওনাকে মৃত ঘোষণা করল। ঘণ্টা তিনেক আগে জুলি মারা গেছেন। হার্ট অ্যাটাকে।
সুবীরবাবু ও পিকু যখন হাসপাতাল হয়ে বাড়ি ফিরল, রাত তখন তিনটে। গাড়িতে প্রায় একঘণ্টা কেউ কারও সঙ্গে কথা বলেনি।
ঘরে ঢোকার পরে সুবীরবাবুই প্রথমে কথা বললেন।
–যতই বলুক হার্ট অ্যাটাক, আমার সন্দেহ হচ্ছে। কালই ফোনে যখন কথা হল, তখনই উনি বললেন একটা দরকারি জিনিস খুঁজে পেয়েছেন। ডেভের লেখা একটা ছোট নোট। তাতে পাম স্প্রিং বলে একটা জায়গার উল্লেখ ছিল। এটা নাকি নিউইয়র্ক যাওয়ার দু-তিনদিন আগে লেখা। তার নীচে জয়ন্তর নামও ছিল। আমি যখন আরও জিগ্যেস করলাম, উনি ফোনে বলতে দ্বিধা করলেন। বললেন দেখা হলে বলবেন।
–তা আপনি আগে বলেননি কেন?
–তখন কি আর মারা যাবেন বুঝেছি! ভেবেছিলাম দু-একদিনে তো যাবই।…জুলির মৃত্যু সম্বন্ধে তোমারও কি সন্দেহ হয়?
–এটা হার্ট অ্যাটাক নয়। প্লেন অ্যান্ড সিম্পল মার্ডার। আর একটা কথা বলে রাখি। আমরাও ওদের টার্গেট। ওরা যে-কোনওভাবে আসল সত্য লুকোতে চায়। বাবাই-এর রিসার্চ থেকে এয়ারক্র্যাশ–আসল ঘটনা যেন কোনওভাবে প্রকাশ না হয়।
হু! বলে সুবীরবাবু পিকুর দিকে এগিয়ে এসে বললেন, কুছ পরোয়া নেহি। আমি তোমার সঙ্গে আছি। এই ডালরুটির জীবনে আমার এমনিতেই আগ্রহ নেই। রহস্য উদ্ধার করতেই হবে। যে-কোনও মূল্যে।
একটু থেমে সুবীরবাবু ফের বলে উঠলেন,–আরেকটা কথা। আমাকে সব কথা বলো। এই যেমন তোমার ছোটবেলার লুডোর কথাটা আমাকে আগে বলোনি। খুব বড় রহস্য বুঝলে! দাঁড়াও সবগুলো পয়েন্ট একটু একজায়গায় নোট করে নিই।
বলে ডাইনিং টেবিলের ওপর রাখা একটা ছোট নোটবুক বার করে লিখতে থাকলেন।
এক, তোমার লুডোতে কী ভেবে তোমার বাবা ওই দুটো সংখ্যাতে আগে থেকে ক্রশ করলেন। আর তা কী করে মিলে গেল ওনার মৃত্যুর দিনের সঙ্গে!
দুই, ওনার মৃত্যুর পরে কে টাকা পাঠাল ইনোভেটিভ সলিউশনসের নামে।
তিন, তোমার বাবা কেন এত গোপনীয়তার সঙ্গে ওনার আসল পরিচয়টা তোমাদের থেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন।
চার, ওনার বন্ধু ডেভ জর্ডন–তিনিও কীভাবে টের পেলেন যে ওনারও সময় ফুরিয়ে আসছে।
পাঁচ, ডেভের লেখা নোটে আসলে কীসের উল্লেখ ছিল। ছয়, জুলির মৃত্যু, জুলি কি কিছু টের পেয়েছিল?
সাত, তুমি ও তোমার দাদা। কেন তোমাকে ঠিক তোমার দাদার মতো দেখতে? উ অনেকগুলো খেয়াল করার মতো পয়েন্ট।
পিকু বলে উঠল–তা লিখছেন যখন–আরও লিখুন। আট-ড্যানিয়েল কী করে আমার নাম জানল?
তাই নাকি? ওই চেস চ্যাম্পিয়ন ছোঁড়াটা?
–হ্যাঁ–খেলতে খেলতে হঠাৎ করে পিকু বলে ফেলেছিল। অন্যমনস্ক হয়ে পিকু ফের বলে উঠল–নয় নম্বর শুধু দাদা নয়। আমার মতো দেখতে আরেকজন কেউ কি আছে? যেমন ড্যানিয়েল বলল। সে-কে?