পিকু একটু চুপ থেকে বলল,ছোটবেলায় কিছু বুঝতে না পারলেও সম্প্রতি আমারও একই কথা মনে হয়েছিল, আর তাই আমি এখানে–
বলে ও ছোটবেলার লুডোর কথাটা খুলে বলল।
মন দিয়ে শুনে জুলি বললেন,–এই এয়ারক্র্যাশটার ব্যাপারে যে চিফ ইনভেস্টিগেটর ছিল তার সঙ্গে আমি দেখা করি। প্রথমে কিছু বলতে চায়নি। কিন্তু আমি কয়েকমাস ধরে লেগে থাকি। জানতে পারি ওনার বেশ কিছু সন্দেহ হয়েছিল। ওনারও মনে হয়েছিল ফ্লাইটে কোনও ধরনের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। অজানা কারণে ব্ল্যাকবক্সে কিছুই ধরা পড়েনি। টেররিস্ট অ্যাকটিভিটি-ও হতে পারে। কিন্তু ওনাকে সেটা প্রকাশ করতে দেওয়া হয়নি। তা ছাড়া উনি দেখেছিলেন সেদিনকার ওই ফ্লাইটে ফাইনালি কারা উঠেছিল সেই নামের লিস্টও নেই। ওনার মনে হয়েছিল যে কেউ যেন ওই ডেটা এয়ারলাইনস-এর ডেটাবেস থেকে ইচ্ছে করেই উড়িয়ে দিয়েছে যাতে কেউ না জানতে পারে প্লেনে কে কে ছিল।
আশ্চর্য! কিন্তু আপনি এটা জানার পর কিছু করেননি?
–চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কোনও ফল হয়নি। ইনভেস্টিগেশন জোর করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
কফির কাপটা টেবিলের ওপর রেখে জুলি যেন প্রসঙ্গ বদলানোর জন্যই বললেন, তা, তোমার নাম কী?
–পিকু।
বাহ, সুইট নেম। তোমার বাবার কথা নিশ্চয়ই খুব মনে পড়ে।
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে পিকু বলে,–আচ্ছা আমার দাদাকে কি আপনি দেখেছিলেন?
–হ্যাঁ, তোমার দাদা এখানেই মারা যায়, চার কি পাঁচ বছর বয়সে। তখন তোমার বাবা-মা কলোরাডোতে। খুব সম্ভবত 1996-এ। হঠাৎ দুদিনের এক অজানা জ্বরে তোমার দাদা মারা যায়। ভারি মিষ্টি ছিল ছেলেটা। তোমার বাবা-মা খুব ভেঙে পড়েছিল। প্রথম সন্তান বলে কথা! তোমার বাবা ওর ডিএনএ পর্যন্ত সংগ্রহ করে রেখে দিয়েছিল। তুমি বাড়িতে ওর কোনও ছবি দ্যাখোনি?
না, আগে দেখিনি। কিছুদিন আগে ইন্ডিয়াতে একটা আলমারির ভেতর থেকে প্রথম ওর একটা ছবি পাই। প্রথমে ভেবেছিলাম আমারই ছোটবেলার ছবি। পরে খুঁটিয়ে দেখে বুঝি যে ওটা আমার নয়, কিন্তু অবিকল আমারই মতো দেখতে।
–তোমারই মতো? দ্যাট মিনস–বলে চুপ করে গেলেন জুলি।
কী?
দ্যাট মিনস–তুমি হোচ্ছ তোমার দাদার ক্লোন। তোমাদের দুজনেরই একই ডিএনএ। তাই একরকম দেখতে। তোমার দাদার ডিএনএ তো ছিলই। তা থেকে ক্লোনিং টেকনোলোজি ব্যবহার করে সেই ভ্রুণ থেকে তোমাকে তৈরি করা হয়। ক্লোনিং কী করে করতে হয় তা জয়ন্ত তার মানে জেনে গিয়েছিল।
–1997-এ ক্লোনিং! হেসে উঠলেন সুবীরবাবু।
–অন্য কেউ হলে আমিও বিশ্বাস করতাম না। এখনই যেটা সম্ভব হয়নি তা পঁচিশ বছর আগে! জুলি একটু থেমে ফের বলেন, জয়ন্ত ওর সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে ছিল। বুদ্ধির দিক থেকে ও নিজেই ছিল অতিমানব। ওর পক্ষে কিছুই অসম্ভব ছিল না। তা ছাড়া এখনও আমার মনে পড়ে ও আর বিতান তোমার দাদা মারা যাওয়ার পর কীরকম ভেঙে পড়েছিল। তার কিছুদিন পরের কথা, আমরা জানতে পারি যে জয়ন্ত তোমার দাদার ডিএনএ সংগ্রহের ব্যবস্থা করেছে। তখন আমি জিগ্যেস করতে তোমার বাবা বলেছিলেন, আমি শান্তনুকেই ফিরে পেতে চাই। ছেলে হলে ওরকমই ঠিক হতে হবে। আমি ওকে ফিরিয়ে আনবই। কথাটার মধ্যে এমন একটা একগুয়েমি ছিল যে আমি খুব অবাক হয়ে যাই।
–আমারও ছোটবেলাতে কেন জানি মনে হত আমার সঙ্গে অদৃশ্য কারুর যেন তুলনা চলছে। আমি যেন ঠিক তারমতো হলে বাবা-মা খুব খুশি হন। বলতে বলতে থেমে গেল পিকু।
যেখানে পিকু বসেছে তার সামনেই ইউরোপিয়ান ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের বড় জানলা। খানিকটা দূরে একটা ওক গাছ। ও দিকটা পুরো জঙ্গল হয়ে আছে। কেন জানে না ওর মনে। হল গাছের ঝোপের মধ্যে কেউ একটা দাঁড়িয়ে ছিল। এদিকে লক্ষ করছিল। দ্রুত অন্য একটা ঝোপের পেছনে চলে গেল। মনে হল লোকটার গায়ের রং যেন সবুজ। আর তাই আগে চোখে পড়েনি। জানলার কাছে গিয়েও চোখে কিছু পড়ল না।
কথাটা আর বলল না পিকু, কিন্তু আলোচনার সুর যেন কেটে গেল। আরও আধঘণ্টা পরে ওরা জুলির কাছ থেকে বিদায় নিল। জুলি গাড়ি অবধি এগিয়ে দিতে এসে বলে উঠলেন, আবার এসো। অনেকদিন বাদে মনে হল আমি যেন সেই দিনগুলোতে ফিরে যেতে পেরেছি। আমার নাম্বারটা রেখেছ তো? কোনও দরকারে ফোন কোরো। আমি ডেভ-এর পুরোনো ডায়েরি, অ্যালবাম ঘেঁটে দেখব যদি ওখান থেকে কোনও সূত্র মেলে। এর পেছনে বড় কোনও শক্তি, বড় কোনও রহস্য আছে। আমার মনে হয় ডেভ আর জয়ন্ত দুজনকেই মার্ডার করা হয়েছে। ওরা হয়তো সেটা আগে থেকেই টের পেয়েছিল। প্রশ্নটা এখানেই যে কেন ওদের মারা হল, আর সব জেনেও ওরা চুপ করে বসে রইল কেন? বিপক্ষশক্তি কি সত্যিই এতটাই শক্তিশালী ছিল যে ওদের কোনও বাঁচার উপায়ই ছিল না? আমার এক বন্ধু ইউ এস সেক্রেটারি অফ ডিফেন্সকে ভালো করে চেনে। আমি তার সঙ্গে আবার কথা বলব, যাতে তদন্ত আবার চালু করা হয়।
গাড়িতে উঠে বসল ওরা। সুবীরবাবু হঠাৎ করে 40 স্পিড লিমিটের রাস্তায় 100 তুলে বলে উঠলেন,বুঝলে পিকু, সারা জীবনটা বড্ড একঘেয়ে ভাবে কাটালাম। রোজই এক রুটিন। রোজই নিয়ম মেনে সব কিছু করা। না আছে কোনও চমক, না আছে কোনও অ্যাডভেঞ্চার। আজ কেন জানি মনে হচ্ছে বড় একটা রহস্যের মধ্যে ঢুকে গেছি।