জুলি ফের বলে উঠলেন,জয়ন্ত আমাদের খুব ক্লোজ বন্ধু ছিল। ও ছিল ব্রিলিয়ান্ট সায়েন্টিস্ট। কোনওদিন নোবেল প্রাইজ পেলেও অবাক হতাম না।
পিকু অবাক হয়ে বলল,আচ্ছা, বাবা তো সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন বলে আমরা জানতাম।
জুলি কষ্ট করে হেসে বললেন,–ও ওর আসল পরিচয়টা লুকোত। কেন জানি না। এমনকী বিতানও ওর কাজের ব্যাপারটা কতটা জানত জানি না। বিতানই তো তোমার মায়ের নাম, তাই না?
পিকু মাথা নেড়ে সায় দিল।
জুলি বললেন,–ওর রিসার্চের সাবজেক্ট ছিল বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। এ বিষয়ে ও ছিল প্রথম সারির বিজ্ঞানী। ও আর ডেভ মিলে ডিএনএ সিকোয়েন্সের ওপর বেশ কিছু অসাধারণ গবেষণা করেছিল। শুধু মানুষ নয়, নানান জন্তু-জানোয়ারও ডিএনএ-এর ঠিক কী বৈশিষ্ট্যের জন্য কী স্পেশাল ক্ষমতা পায় তা নিয়েও ওদের গবেষণা অনেকদূর এগিয়েছিল। এই যেমন ধরো, কুকুরের ঘ্রাণশক্তি কিংবা গিরগিটির রং বদলানোর ক্ষমতা, বা পুমার লাফানোর ক্ষমতা–এ তো তাদের ডিএনএ-র বিশেষ সিকোয়েন্সেরই জন্য। ডেভ আর জয়ন্ত সেই সিকোয়েন্স। কী তা প্রায় জেনে গিয়েছিল। মানুষের ডিএনএ-তে কীভাবে সেই একই পরিবর্তন আনা যায় তা নিয়ে ছিল ওদের গবেষণা।
কিন্তু এসব রিসার্চ তো এখন নিষিদ্ধ। সুবীরবাবু বললেন।
–আমি তো এখনকার কথা বলছি না। তখন এসব নিষিদ্ধ ছিল না। এসব করলে কী সাংঘাতিক ফলাফল হতে পারে তার সম্বন্ধে কেউ সচেতন ছিল না।
–তা এসব করে লাভ কী হত? সুবীরবাবু ফের প্রশ্ন করলেন।
কী আবার! মানুষ যদি ঈগলের মতো দূর থেকে দেখতে পেত বা আঙুল কেটে গেলে নিজের থেকে তৈরি করতে পারত তাহলে নিশ্চয়ই ভালো হত, তাই না? কেউ যদি চিতাবাঘের মতো দৌড়োতে পারত আর সিংহের মতো শক্তিশালী হত তাহলে তাকে কি আর সাধারণ মানুষ প্রতিযোগিতায় হারাতে পারত? হয়তো ওরা অতিমানব তৈরি করার চেষ্টা করছিল।
–কিন্তু আমার বাবাই কখনই এরকম কিছু করতে পারে না। বাবাইকে যতটুকু দেখেছি, বাবাই সম্বন্ধে যা শুনেছি বাবাই কখনও অন্যায় কিছু করত না। এভাবে অতিমানব তৈরি করা এতো একধরনের অন্যায়। সাধারণ মানুষ কি টিকে থাকতে পারবে এদের সঙ্গে লড়াই করে?
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। জয়ন্ত নিজের ইচ্ছেতে এরকম কিছু করত না। ও মানুষ হিসেবেও ছিল খুব বড়। দার্শনিকের মতো কথা বলত মাঝেমধ্যে। খুব দূরদৃষ্টি ছিল। আমার মনে হয় না ওরা এই ভুল করত। কিন্তু আমার কেন জানি না মনে হত ওরা খুব ভয়ে ভয়ে ছিল শেষের কয়েকটা বছর। কেউ যেন আড়াল থেকে ওদের কন্ট্রোল করত। ডেভ আমার সঙ্গে কোনও কথা বলত না। কথায় কথায় অন্যমনস্ক হয়ে যেত। কলিংবেল-এর আওয়াজে নার্ভাস হয়ে পড়ত। অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এলে ধরত না।
–এটা কোন সালের কথা?
–এই ধরো, 2000 থেকে 2002–এই দু-বছর। তখন ওকে আমি দেখেছি সম্পূর্ণ। অন্যরকম হয়ে যেতে।
–আমার বাবা তো ওই সময় ভারতে চলে যান।
–হ্যাঁ, কিন্তু ও এখানে প্রায়ই আসত। ওরা দুজনে মিলে ওপরের ঘরে বসে অনেক রাত অবধি কীসব আলোচনা-গবেষণায় ব্যস্ত থাকত। এখানে তোমাদের একটা বাড়িও ছিল, তা জানো তো? সেখানেও ডেভ আর জয়ন্ত অনেক সময় একসঙ্গে কাটাত। তারপর একদিন হঠাৎ সব শেষ হয়ে গেল। এয়ার ক্র্যাশে।
জুলি থামলেন। ঘরে পিনড্রপ সাইলেন্স। খানিকবাদে পিকুই নীরবতা ভঙ্গ করল।
–আপনি গিয়েছিলেন ক্র্যাশ সাইটে?
–হ্যাঁ, কিন্তু ওখানে তো ওরা একেবারে কাছে যেতে দেয়নি। বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে প্লেনের ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে পড়েছিল। পুরো জায়গাটা ঘিরে রেখেছিল ওরা।
–ডেডবডি দেখেছিলেন?
সবাই এত পুড়ে গিয়েছিল যে কাউকে চেনার উপায় ছিল না। তবে ক্রেডিট কার্ড, আইডি–এসব থেকে ক্র্যাশ ইনভেস্টিগেশন টিম ওদের সনাক্ত করে। তবে ওরা যে মারা গিয়েছিল তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
–আপনার কি সত্যিই কোনও সন্দেহ নেই এ ব্যাপারে? পিকু বলে উঠল। ওর কেন জানি না মনে হল ভদ্রমহিলা নিজেই নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন। তা না হলে হঠাৎ ওকথা বললেন কেন?
খানিকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে পিকুর দিকে তাকিয়ে রইলেন জুলি। তারপর হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,কফি চলবে? কফি খেতে খেতে বলব।
ঘরের পরিবেশ বেশ ভারী হয়ে আছে। সেই ভার খানিকটা কাটাতেই পিকু সায় দিল।
খানিকবাদে কফি, কিছু স্ন্যাকস আর সসেজ নিয়ে ফিরে এলেন জুলি। পিকুর কেন জানি না মনে হল বহু বছর বাদে জুলি যেন কথা বলার লোক খুঁজে পেয়েছেন। যে সব কথা কাউকে কোনওদিন বলা যায়নি, সেসব যেন বলার সময় এসেছে।
কফিতে চুমুক দিয়ে জুলি বলে উঠলেন,আচ্ছা কেউ কি এরকম অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার আগে মৃত্যু টের পায়? আমার কেন জানি মনে হয় ডেভ বুঝতে পেরেছিল যে আমাকে চিরকালের মতো ছেড়ে চলে যাবে। তাই ওর সব ভালোবাসা-দরকারি সব কথা ও যেন জানিয়ে গিয়েছিল শেষের কদিনে। দরকারি সব কম্পিউটারের ফাইল নিউইয়র্কে যাওয়ার কয়েকদিন আগে দেখিয়ে দিয়েছিল। আমি তখন খানিকটা অবাকই হয়েছিলাম।
নিউইয়র্ক?
–হ্যাঁ, ও শেষ এক সপ্তাহ নিউইয়র্কে ছিল। একটা মেডিক্যাল কনফারেন্সে। সেখান থেকে ফিরতে গিয়েই এই এয়ারক্র্যাশ হয়। তোমারও কি তোমার বাবার সম্বন্ধে একথা মনে হয়েছিল?
পিকুকে চুপ থাকতে দেখে জুলি ফের বলে উঠলেন,–অবশ্য তুমি আর কী বুঝবে? তুমি তো তখন অনেক ছোট।