তারপর যা হয়, তখন তা হামেশাই হতো। এখন যাকে একটা ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস মনে হবে, তখন সেটাই স্বাভাবিক মনে হতো। দুই কুন্ঠিবাড়ির দুই হাতি বাজিকরের ঘর ভাঙে। ভাদুই ফসলের জমিগুলোকে দাপিয়ে কাদা করে। ঘরে আগুন লাগে। বাজিকর রমণীরা বয়স নির্বিশেষে ধর্ষিতা হয়। ইয়াসিনের মেয়ে পলবি নিখোঁজ হয়। তারপর এই ছিন্নমূল মানুষগুলোকে তাড়িয়ে অনেকদূর পার করে দেয় মহিমবাবু, লালমিয়া ও দিগিন মণ্ডলের লোকেরা। এসব উপভোগ করার মতো দৃশ্য তখন হামেশাই হতোবাচ্চা-কাচ্চা, পোঁটলা-পুটলি নিয়ে মানুষ ছুটছে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে, পিছনে তাড়া করে যাচ্ছে আরেকদল ক্ষিপ্ত মানুষ, ছুঁড়ছে ঢিল।
তখন বর্ষার দিন। মানুষগুলো নদীর পাড় ধরে এগোয়, কেননা নদীর পাড়ে কাদা কিছু কম, পলি অঞ্চল। তারা এগোয় পুবের দিকে। রাস্তায় আট-দশটি শিশু ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধা মরে। মরে দু-জন আসন্নপ্রসবা রমণী। এইভাবে তারা পুবে চল্লিশ মাইল সরে এসে পাতালু নদীর ধারে মোহর হাটখোলায় তাদের বোঝা নামায়।
তাদের জীবন হয় আরো আদিম, আরো নির্মম। তাদের রমণীরা তখন গ্রাম্য হাটুরে মানুষের মনোরঞ্জন করে ক্ষুগ্নিবৃত্তির চেষ্টা করে। পুরুষরা চুরি জোচ্চুরি করে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখে। আবার ঢোলকের চামড়ায় কাঠি পড়ে, আবার বহু চণহালের হাড়ে তেল সিঁদুর লাগে, অনভ্যস্ত পায়ে টানটান দড়ির উপরে হেঁটে যায় বাজিকর বালিকা। আবার তার মধ্যেই কখনো আনুষ্ঠানিক গান ওঠে–
এ সে হালদি লাগিরে
এ তো মায়েরি
তেল মেশুরে লুড়ে
এ তো মায়েরি।
৪৪.
পরবর্তী ছ-মাস বাজিকরেরা মোহরের হাটখোলায় প্রায় খোলা আকাশের নিচে থাকে। এর মধ্যে পাঁচবিবি আর মোহরের এই চল্লিশ মাইল দূরত্বের মাঝামাঝি জায়গায় সীমানা চিহ্ন হয়। পাঁচবিবি পড়ে পাকিস্তানে, মোহর ভারতে। মোহরের উপর নতুন মানুষের চাপ বাড়ে। জমি বদল হয়, জমি দখল হয়। জমির দাম বাড়ে, মানুষের দাম কমে। দেশের মানচিত্রে ও শাসনযন্ত্রে নানারকম পরিবর্তন হয়।
কিন্তু বাজিকরদের বিগত পঞ্চাশ বছরের জীবনের সঙ্গে পরবর্তী তিরিশ বছরের কোনো তফাত হয় না। পঞ্চাশ বছর আগে জামিরের নেতৃত্বে যে প্রয়াস শুরু হয়েছিল ইয়াসিনের নেতৃত্বে আবার নতুন করে তা শুরু হয়। গত পঞ্চাশ বছরে যে অভ্যাস ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে তার থেকে আর রেহাই পায় না বাজিকর। বাজিকর আর পুরোপুরি বাসিয়া বাজিকর হতে পারে না। খেলা দেখায় ভিখ মাঙ্গে ঠিকই কিন্তু প্রাচীন জীবনে সে আর ফিরে যেতে পারে না। দুই পুরুষে পৃথিবীর রাস্তা তার কাছে সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে, পা সীমাবদ্ধ পরিচিত পথের মাপে।
কাজেই আজুরা মণ্ডলের আনাগোনাকে কাজে লাগাতে হয়। আজুরা ভয়ঙ্কর মুখাকৃতির ছোটখাটো চেহারার মানুষ। হঠাৎ মুখ দেখলে ভীষণ বলিষ্ঠ মনে হয়। পাশবিক মনে হয়। কোনোকালে হয়ত সারামুখে অজস্র ব্রণ হতো। এখন হয় না। কিন্তু অতীতের সেই ক্ষত মুখটাকে উঁচু নিচু একটা খসখসে কর্কশ রূপ দিয়েছে। তার চোখ স্থির, খুনীর মতো। সে প্রচুর জমির মালিক, কিন্তু সে পাঁচবিবির অবস্থাপন্নদের মতো হাতি-পোষা বড়লোকি করে না। কারণ পাঁচবিবি মোহর থেকে অনেক এগিয়ে। আজুরা মোহরের মাপের মানুষ। আজুরার ভোগবৃত্তি সবই মোহরের মাপের। দিগিন মণ্ডল পলবিকে লুঠে নিয়ে ভোগ করে, আর আজুরা সরাসরি বাজিকরের পাতার ঘরে আসে, গল্প জমায়, সরাসরি প্রস্তাব ও লেনদেন করে।
হাটখোলায় হাটুরে রসিকরা আসে, আজুরা আসে, কেরোসিনের লম্ফ জ্বলে, নেভে। পুরুষেরা কেউ এ নিয়ে কথা তোলে না, মেয়েরা এ নিয়ে পাতালুর নদীর গিয়েও আলোচনা করে না। কোনো আলোচনা না করেও সবাই ধরে নেয় পথচলতি রাস্তায় একটা অত্যন্ত অবর্জনাভরা বাঁক। এ বাঁকটা পেরোলেই ভালো, পরিষ্কার রাস্তা পাওয়া যাবে। কেউ এ আশ্বাস দেয়নি, তবুও।
ছ-মাস পরে মোহর হাটখোলা ছেড়ে ইউনিয়ন বোর্ডের রাস্তার দুপাশে বাজিকরেরা তাদের নতুন করে কাদামাটির দেয়াল তোলে। আজুরা তাদের সহায় থাকে, কাজেই বিশেষ প্রতিবন্ধকতা হয় না। আজুরার জঙ্গলাকীর্ণ বিশাল ভিটা জমি সমতল হয়ে আবাদি জমি হয়। ওপার থেকে ক্রমাগত মানুষ আসতে থাকে জমির ব্যবহার বাড়ে। ফসলের দাম দ্বিগুণ হয়। আজুরা তৈরি জমি বিক্রি করে ও বাজিকরদের সহায়তায় পতিত জমি উদ্ধারে মন দেয়। অলিখিত শর্ত থাকে পাঁচবিবির মহিমবাবুর মতো। অর্থাৎ বাজিকরেরা সেই পুরানো স্বপ্ন দেখে, খালাসি জমির আধি পাওয়ার স্বপ্ন। এইভাবে তারা আজুরার আশ্রয়ে থাকে। আজুরা একথা ভেবে শ্লাঘা বোধ করে ও বাজিকরেরা তার প্রতি কৃতার্থ থাকে। আজুরার সঙ্গে বাজিকরদের সম্পর্ক আরো দৃঢ় হয় যখন সে লছমনের মেয়ে নসিবনকে তার পাঁচ নম্বর উপপত্নী করে।
রাস্তার পাশের নতুন বাড়িতে এসে শারিবার মা মধ্যবয়সী শা-জাদি মধ্যবয়সী ইয়াসিনের ঘর করতে চলে যায়। কেননা রূপার ফেরার আর কোনো আশা থাকে না। পলবির মা পাঁচবিবি থাকতেই লোই আর হাতপাক রোগে মারা গিয়েছিল। শাজাদি যদিও ইয়াসিনের চাচাতো বোেন,তবু এ নিয়ে কোনো সমাজ হয় না। কেননা বাজিকরেরা চিরকালই নিজস্ব গোষ্ঠীর মধ্যে বদ্ধ। এখন একেবারেই নিরূপায়। পাশ্ববর্তী কোনো সমাজই তাদের গ্রহণ করে না। কাজেই জান্তব জৈব অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে প্রায় স্বজনগমনই তাদের মেনে নিতে হয়।
মানুষ যেহেতু যে-কোনো জানোয়ারের থেকে অনেক বেশি পরিশ্রমী সেকারণেই বাজিকরেরা নিজেদের অস্তিত্ব রাখতে পারে। আর বাজিকরদের পরিশ্রম আজুরাদের বড় কাজে লাগছে, কাজেই তারা বেঁচে থাকে। কিন্তু জীবন বিবর্ণ, এত বিবর্ণ যে জন্মে কোলাহল হয় না, মৃত্যুতে হাহাকার নেই। অথচ যে-কোনো স্তরের জীবনধারণের সংগ্রামে এই উচ্ছ্বাস দু-টি থাকে, এমনকি পশুদেরও।