বাজিকরেরা এসব ঘটনা প্রত্যক্ষ করে নিজেদের ভবিষ্যৎ গোপনে স্থির করে। তারা বুঝেছিল এমন কোনো জায়গায় পালাতে হবে যেখানে এ আগুনের ছোঁয়া লাগেনি। একজন বিশ্বস্ত লোহারকে তারা গোপনে রাজমহলের খবর আনতে পাঠিয়েছিল। নির্দেশমতো সেই লোহার সালমার সঙ্গে দেখা করেছিল। মৃত্যু তখন বাজিকর ছাউনিতে কারোরই অজানা ছিল না। শুধু এই চারজনের কথা চিন্তা করেই সালমা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। পীতেম আবার নির্বাক হয়ে গেছে, কাজেই দলের সম্বন্ধে সামান্য যেটুকু চিন্তা করার তা সালমাকেই এখন করতে হয়।
সালমা সেই লোহারকে বলেছিল, দল কার্তিকের গোড়াতেই এখানকার ছাউনি তুলবে। গঙ্গা পার হয়ে প্রথমে যাবে মালদা। সেখানে কিছুদিন শহরের কাছাকাছি থাকবে, তারপর আরো পুবে সরে যাবে।
সুতরাং জিষ্ণু পরতাপ, বালি, পিয়ারবক্স দলের গতিপথ সম্বন্ধে আগাম একটা ধারণা করতে পেরেছিল। আর গঙ্গার ওপারে সাঁওতাল বসতি খুবই কম, সেখানে ঝামেলাও নেই। সালমার সিদ্ধান্তে তারা খুশি হয় এবং ঠিক করে প্রথম সুযোেগেই সাঁওতাল দল ছেড়ে পালাতে হবে।
সংগ্রামপুরের যুদ্ধের পর তাদের হাতে সেই সুযোগ এসে যায়। কৌশলে ইংরেজরা পাহাড় ও জঙ্গলের ভেতর থেকে সাঁওতাল বাহিনীকে ফঁকা মাঠে নামিয়ে আনে। তারপর কামান-বন্দুকের সঙ্গে তিরধনুকের বেমানান লড়াই।
সংগ্রামপুরের যুদ্ধে নেতাদের মধ্যে প্রথমে নিহত হয় চাঁদরাই। চাঁদরাইয়ের মৃত্যুর পর আহত বাঘের মতো সাঁওতাল বাহিনী পাহাড় থেকে ঝাঁপিয়ে নেমে আসে। সেদিন ইংরেজ বাহিনী একটা কালো জঙ্গলকে সচল হয়ে নেমে আসতে দেখেছিল। নাকাড়ার শব্দ হয়েছিল মেঘগর্জনের মতো। উন্মাদ লড়াইতে শ’য়ে শয়ে সাঁওতাল মাটি নিচ্ছে, তবুও এগিয়ে আসা দীর্ঘক্ষণ অব্যাহত ছিল।
তারপর সিদু মুর্মু এবং কানু মুর্মু দু-জনেই আহত হতে সাঁওতালরা পিছোতে শুরু করে। নাকাড়া ধামসায় অন্য শব্দ বাহিনীকে পিছিয়ে আসতে ইঙ্গিত করে। ছিন্নভিন্ন সাঁওতাল বাহিনী গভীর জঙ্গলে পালিয়ে যেতে থাকে দুই আহত নেতাকে বহন করে। জয়ের আশা তখন আর তাদের ছি না। সুতরাং মানুষ দল ছেড়েও পালাতে থাকে।
এই সুযোগ বাজিকরেরা ছাড়ে না। প্রথম সুযোগেই এই যুদ্ধে দ্বিতীয়বারের মতো তারা পালায়। চারটি ঘোড়ার গায়ে হেঁড়া কাপড় জড়িয়ে গভীর রাত্রে তারা উত্তরমুখে যাত্রা শুরু করে। উত্তরে গঙ্গাকে পাওয়া যাবে এটুকু ভৌগোলিক জ্ঞান তাদের ছিল, কেননা মানুষের কাছে কিছু জিজ্ঞেস করা, এমনকি মানুষের কাছাকাছি আসাও তাদের পক্ষে বিপজ্জনক। ধরা পড়লে ইংরেজ কিংবা সাঁওতাল কোননা পক্ষই তাদের খাতির করত না।
পাঁচ-ছ’ রাত্রি চলার পর তারা গঙ্গার দেখা পায়। সাহেবগঞ্জের থেকে পাঁচ-সাত ক্রোশ পুবে তারা গঙ্গা পার হয় এবং অপেক্ষাকৃত নিরুপদ্রব পূর্ণিয়া জেলায় প্রবেশ করে।
এইভাবে চার যুবক কখনো ভিক্ষা করে, কখনো চুরি করে, কখনো লোক ঠকিয়ে তাদের ক্ষুগ্নিবৃত্তি করল। যুদ্ধের পর পথশ্রম ও অনাহারে এই চার অশ্বারোহী কৃশকায় ও দুর্বল হয়ে পড়ল। আরোহীদের থেকে ঘোড়াগুলোর অবস্থা হল আরো করুণ। শেষপর্যন্ত তারা আর সওয়ার বহন করতে পারছিল না।
এইভাবে মনিহারিঘাট, হরিশ্চন্দ্রপুর, সামসি এবং গাজোল হয়ে তারা মালদা আসে। তারপর বাদিয়ার মধ্যযুগীয় ছেড়া তাঁবু খুঁজে নিতে তাদের অবশ্য আর অসুবিধা হয় না।
১৯.
হাঁ শারিবা, তোর নানার নানা পীতেম, তার বাপ দনু, তো সি কহিল, পীতে, তুমু পচ্ছিমে লয়, পুবে যাবা। কেন কি, পুবেৎ তরক উঠে আর পচ্ছিমে ডুবে যায়। বাউদিয়া বাজিকর কতদিন দিশাহারা, ততদিন তারা তরককে পাছুতে রাখে, ততদিন তারা খালি পচ্ছিমে যায়। তয় দনু কলেন, পীতেম হে, পীতেম, তুমু পুবে যাও, বাপ। রহু তুমার সহায় হবেন।
শারিবা বলে, তো পুবের দেশেৎ সুখ কই, নানি? রাজমহেলৎ সুখ জুটে নাই, সুখ জুটে নাই এই তাবৎ পুবের দেশে ঘুরে।
হাঁ, শারিবা, সুখ জুটে নাই। শ-বছর পার হই গেল, তাও তত সুখ জুটে। নাকি, সুখ বলে কিছু নাই, নাকি খালি দুর্কের পাথারে সাঁতার খায় বেবাক মানুষ।
সুখ না থাকুক নানি, সোয়াস্তি আছে। তো বাজিকরের কপালে কি তাও বহু লিখে নাই?
লুবিনি কঁপা কাঁপা হাতে শারিবার মুখ চাপা দেয়। ওলা কথা কহে না, শারিবা। ওলা কথা পাপ।
শারিবা বলে, পাপ! নানি, যার সমাজ নাই, তার পাপ নাই। রহু কি হামরাদের ভগবান?
আঃ হা?
হিন্দুর ভগবান আছে, মোছলমানের আছে আল্লা, খিস্টানের যেশু। তো হামরার বাজিকরের রহুই সি ভগবান, কি আল্লা, কি যেশু। লয়?
শারিবা যেন পরখ করে তার নানিকে। যেন শুনতে চায়, বৃদ্ধা এ প্রশ্নের কী উত্তর দেয়।
নানি এ কথার উত্তর খুঁজে পায় না। প্রশ্নটা তার নিজের কাছেই। চতুষ্পর্শের সমাজবদ্ধ মানুষের কাছে এটা কোনো সমস্যাই নয়। সর্বশক্তিমান এক বা একাধিক অস্তিত্বের উপস্থিতি যেখানে জন্মের পরে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতো সাধারণ বিষয়, সেখানে বাজিকর নামক সম্প্রদায়ের এ ধরনের কোনো আশ্রয় নেই—একথা অন্য কারো বোধগম্য নয়। অন্য কারো সমস্যাও নয়।
সমস্যা ছিল পীতেমের, সমস্যা ছিল জামিরের, সমস্যা লুবিনির, শারিবার, সমস্যা কিছু বাজিকরের। রহু ঈশ্বরের মতো সর্বশক্তিমান নয়। সে এক প্রাচীন দলপতি। সে এক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর নীতি নির্ধারণ করত তার জীবদ্দশায়। কিন্তু লুবিনি কিংবা কোনো বাজিকর তাকে ভগবান, আল্লা ইত্যাদির সমগোত্রীয় ভাবতে পারে না। এই অমোঘ শক্তিধরদের যে পরিচয় বৃহত্তর সমাজের কাছ থেকে সে পায়, রহুকে তার সমগোত্রীয় ভাবতে তার শুধু ভয় নয়, অনিচ্ছাও বটে। কাজেই তার বোধের মধ্যেও বহু বেঁচে থাকে এক মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী দলপতির মতো। তার উপরে সে দেবত্ব আরোপ করতে পারে না, কারণ দেবত্ব আরোপ করতে পারার সামাজিক স্থিতি তার নেই। সে সমাজচ্যুত। সে ভ্রাম্যমাণও। পথই তার যাবতীয় নীতিনির্ধারক।