কিন্তু পরের দিকে যাই-ই হোক না কেন, একটু পেছন দিকের ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে যিশু খৃস্টের দ্বিতীয় আবির্ভাব (Second Advent of Christ) হতে চলেছে এবং সামনের এক হাজার বছর ধরে অপার শাস্তির যুগ আসছে।–এমন একটি বিশ্বাস ১৮৩০-৪০ সাল নাগাদ আমেরিকায় প্রচণ্ড আলোড়ন ও উত্তেজনার সৃষ্টি করে। এই ‘একহাজার বছরের আসন্ন শান্তির যুগকে বলা হয় ‘the millennium, (মিল্লেন্নিয়াম) (তুলনীয়, ভারতের হাস্যকর রামরাজ্যের কথাবার্তা) এবং এ সম্পর্কিত ধর্মীয় আন্দোলনের নামই হয় ‘millenarian movement’। এই আন্দোলনের মধ্যেই পরবর্তীকালে সৃষ্টি হওয়া ফান্ডামেন্টালিজম’-এর শেকড় লুকিয়ে আছে। ঐ ধরনের বিশ্বাস, তার প্রচার, তাকে কেন্দ্র করে নানা স্বার্থের নানা ধরনের সাংগঠনিক ধর্মীয় প্রয়াস—এগুলি ‘নায়াগ্রা বাইবেল সম্মেলন’ (Niagara Bible Conference)-এর মধ্য দিয়ে একটি নির্দিষ্ট আন্দোলনে সুসংহত হয়। নিউ ইয়র্ক শহরের ব্যাপটিস্ট যাজক জেমস ইংলিশ (James Inglis)। ১৮৭২ সালে তাঁর মৃত্যুর অল্পদিন আগে এই সম্মেলনের প্রারম্ভিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর পর ‘সেন্ট লুই প্রেসবিটেরিয়ান’ (Presbyterian) যাজক জেমস এইচ ব্রুকস (James H. Brooks) (১৮৩০-৯৭)-এর অধীনে এর কাজ চলতে থাকে। জেমস ব্রুকস ছিলেন প্রভাবশালী মিলেনারিয়ান পত্রিকা ‘দি টুথ’-এর সম্পাদক।
তবে এই ‘মিলেনারিয়ান’ আন্দোলনের আগে প্রটেস্টান্ট চার্চের মধ্যে পুনরভ্যুত্থানবাদ বা revivalism নামে আরেকটি ধারার সৃষ্টি হয়েছিল, যা আমেরিকায় এই ফান্ডামেন্টালিজম’-এর সৃষ্টিকে প্রভাবিত করেছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইংল্যাণ্ডে এর উদ্ভব হয় এবং পরে উত্তর আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। এই তত্ত্বের নাম থেকেও খৃস্টধর্মের শক্তিকে আবার বাড়িয়ে তোলার আকাঙ্খার ব্যাপারটি বোঝা যায়। এর অনুগামীরা খৃস্টধর্মের প্রভাবকে সংহত করা এবং আরো বিস্তার করার প্রচেষ্টা চালায়। আমেরিকায় প্রসারিত এই ধারাই কয়েক দশক পরোকার মিলেনারিয়ান বিশ্বাস ও পরোকার ফান্ডামেন্টালিজম-এর পথ প্রশস্ত করে।
এই রিভাইভ্যালিজম’-এর উদ্ভবও ধর্ম ও বাইবেল বিরোধী বাতাবরণের প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি। সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ইয়োরোপে মূলত দরিদ্র ও সমাজের পিছিয়ে থাকা মানুষদের উদ্যোগে প্রথাবিরোধী বিশ্বাস ও কাজকর্মের একটি তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। ডিগার, র্যান্টার, লেভেলার, কোয়েকার ইত্যাদি নামের নানা গোষ্ঠীর মধ্য দিয়ে প্রচলিত খৃস্টধর্ম তথা বাইবেলের বিরুদ্ধেবিদ্রোহী চেতনার এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নানা ঐতিহ্যগত প্রাচীন ধারণা ও বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার প্রয়াস সংগঠিত হয়েছিল। র্যান্টাররা বাইবেলকে মনে করতেন যত দুঃখকষ্ট, বিভেদ ও বিশ্বব্যাপী রক্তপাত –এর কারণ। কারো মতে ওটা ধাপ্লাবাজিতে ভরা। কেউ (ওয়ার্ল্ডউইন) বলেছেন, ‘বাইবেল স্ববিরোধিতায় ভর্তি এবং তাকে ঐশী বাণী বলেও গ্রহণ করতে তারা রাজী নন। কেউ (বোথােমলি) বাইবেলকে রূপক হিসেবে গণ্য করেন এবং তাকে কোন সৎ লোকের লেখা যে কোন গ্রন্থের সমতুল্য’ বলে মনে করেন এবং এই ধরনের দু একটি উদাহরণ সপ্তদশ শতাব্দীর ধর্মবিরোধী সামাজিক আন্দোলনের পরিচায়ক অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ মাত্র। আপাতত এ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে বলা যায় যে, সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও চেতনার বিকাশের অনেক আগেই, ইয়োরোপের শিল্পবিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত কল্পতে ও তার প্রাসঙ্গিকতায় এ ধরনের প্রথাবিরোধী, ধর্মবিরোধী ও বাইবেলবিরোধী তীব্র মতাদর্শ জনগণের মধ্যে গড়ে উঠছিল। একে রুখতে একে একে সৃষ্টি হয়েছিল রিভাইভ্যালিজম, মিলেনারিয়ান আন্দোলন, ফান্ডামেন্টালিজম তথা মৌলবাদ। বিংশশতাব্দীর শেষ প্রান্তে ধর্ম যতই কোণঠাসা হচ্ছে ততই এই হতাশ মৌলবাদও আপ্ৰাণ শেষ লড়াই চালাচ্ছে। সে অন্য প্রসঙ্গ। আপাতত আমরা মিলেনারিয়ান আন্দোলনেই ফিরে যাই।
গোঁড়ার দিকে অন্যান্য মিলেনারিয়ান নেতৃত্বের মধ্যে আরো কয়েকজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন–ব্যাপটিস্ট ইভাঞ্জেলিস্ট জর্জ সি. নীডহ্যাঁম (George C. Needham; ১৮৪০-১৯০২), প্রেসবিটেরিয়ান যাজক উইলিয়াম জে. আর্ডম্যান (William J Erdman; ১৮৩৪-১৯২৩) (বাইবেলের ব্যাখ্যাতা হিসেবে এর বিশেষ প্রসিদ্ধি ছিল), উইলিয়াম আর নিকলসন (William R. Nicholson; ১৮২২-১৯০১),–ইনি ১৮৭৩-এ এপিস্কোপাল চার্চ ছেড়ে ছোট্ট গোষ্ঠী রিফর্মড এপিস্কোপালএর বিশপ হয়েছিলেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বেষ্টনের বিখ্যাত ব্যাপটিস্ট যাজক অ্যাডোনিরাম (šī ti (Adoniram J. Gordon; ১৮৩৬-১৮৯৫) ও চার্চ অব কানাডায় হুরোনের বিশপ মরিস বন্ডউইন (Maurice Baldwin; ১৮৩৬-১৯০৪)-এর মত ব্যক্তিরাও এই মিলেনারিয়ান আন্দোলনে আকৃষ্ট হন।
১৮৯৯ অব্দি সাধারণত নায়াগ্রা অন দি লোক (ওন্টারিও)-তে এই গোষ্ঠী প্রতি বছর গ্ৰীষ্মে সম্মেলনের আয়োজন করতেন। আর ১৮৭৮ থেকে ঐ নায়াগ্রা সম্মেলনের সঙ্গে যুক্ত মিলেনারিয়ানরা বড় বড় শহরেও বহু প্ৰকাশ্য সম্মেলনের পৃষ্ঠপোষকতা করতে শুরু করেছিলেন যেমন নিউইয়র্ক শহরের ‘বাইবেল অ্যাণ্ড প্রফেটিক কনফারেন্স’।