এরা একেবারে সাধু-সন্ন্যাসী গোছের না হলেও, এঁদের কিছু নিজস্ব আচার আচরণ বিধিনিষেধ রয়েছে। অধিকাংশ Fundamentalist (ফান্ডামেন্টালিস্ট) ধূমপান করেন না, মদ্যজাতীয় কোন পানীয় গ্রহণ করেন না, নাচে অংশ গ্ৰহণ করেন। না বা নাচেন না এবং এমনকি সিনেমা, নাটক ইত্যাদি দেখেন না। এঁদের নিজস্ব, ফান্ডামেন্টালিস্ট কলেজ ও বাইবেল ইনস্টিটিউট রয়েছে। অন্তত এগুলিতে পূর্বোক্ত বিধিনিষেধগুলি কঠোরভাবে পালন করা হয়। এদের ঈশ্বর উপাসনার পদ্ধতিতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে কিছু তফাৎ থাকতে পারে, তবে সাধারণতঃ গীর্জ বা যাজকের ভূমিকা তাতে থাকে না। কিন্তু বাইবেলকে অপরিবর্তনীয় বিতর্কাতীত সর্বোচ্চ নেতৃত্বের গ্রন্থ হিসেবে গ্ৰহণ করা এবং প্রাচীন আচারপদ্ধতিকে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারটি তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। আর একসঙ্গে জড়ো হয়ে গান ও প্রার্থনার সঙ্গে ধর্মোপদেশ দেওয়াটা ফান্ডামেন্টালিস্ট উপাসনা প্রক্রিয়ার একটি সাধারণ দিক।
এধরনের বাহ্যিক কিছু দিকের মধ্যে ফান্ডামেন্টালিস্ট-দের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, বাইবেলের কোন ধরনের সমালোচনাকে বা পরিবর্তনকে সহ্য না করার মানসিকতা। এর সঙ্গে আধুনিকতা (modernism), আধুনিক মতাদর্শগত বিতর্ক, যুক্তিবাদ ইত্যাদি এবং বিশেষত বিবর্তনবাদ ও এই ধরনের আধুনিক দৈত্য’ (demon)–দের ঘূণার সঙ্গে পরিহার করার মানসিকতাও এঁদের বিশেষ চারিত্রিক লক্ষণ। কিন্তু আধুনিকতার সঙ্গে তাদের এই বিরোধ (Fundamentalist-modernist controversy) আসলে বেশ পরেকার ব্যাপার-প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক নাগাদ এটি পরিষ্কার রূপ পায়।
কিন্তু ফান্ডামেন্টালিজম-এর ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অনেক আগে এবং এক্ষেত্রেও পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতি, বৈজ্ঞানিক চেতনার ক্রমবিকাশ, অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ৰমপরিবর্তন ইত্যাদির ফলে যখন ধর্মের অস্তিত্ব ও চিরাচরিত। ঐতিহ্যের উপর আঘাত আসতে থাকে তখন তার প্রতিক্রিয়ায় এধরনের চরম প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। সব সময়ে সমাজে নতুন প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা যখন আসে, তখন তার বিরুদ্ধে পুরনো চিন্তাভাবনা কিছুকাল। লড়াই চালাতেই থাকে। ধর্মের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি মৌলবাদের রূপ ধারণ করতে পারে এবং জেতার জন্য তার এই লড়াই জঙ্গী, মরিয়া ও আগ্রাসী হয়ে ওঠে। সমাজের কিছু মুক্ত চিন্তার মানুষ জ্ঞান ও সমাজের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পুরনো ধ্যানধারণার পরিমার্জনা-এমনকি বৈপ্লবিক রূপান্তরও ঘটান, কিন্তু অন্য কিছু মানুষ প্রাচীনকেই পরম সত্য বলে আঁকড়ে রাখেন-যা মৌলবাদেরই একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। নতুন চিন্তা যদি সত্য ও শক্তিশালী হয় তবে তার জয় এর ফলে বিলম্বিত হলেও, অবশ্যম্ভাবী। এবং পরবর্তী কালের নতুনতর আরো বিকশিত চিন্তার সঙ্গে তারও দ্বন্দ্ব শুরু হয়, তখন আগেকার একদা প্রগতিশীল চিন্তা প্রতিক্রিয়াশীলের ভূমিকা পালন করে বা করতে পারে। সমাজ বিকাশে এবং এই বিকাশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে উৎপাদন ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ক, চিন্তাভাবনা ইত্যাদির ক্ষেত্রে এধরনের সর্বদা পরিবর্তনশীল দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া অবিচ্ছেদ্য একটি দিক এক সময় যে প্রতিষ্ঠানিক ধর্ম সমাজে প্রগতিশীল ও প্রয়োজনীয় হিসাবে সৃষ্টি হয়েছিল, কিছু পরে তাইই প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে।
খৃস্টধর্মের জড়বদ্ধতা, বিশেষত তার আচার সর্বস্বতা, কায়েমী স্বার্থের সংকীর্ণতা–এসবের প্রতিবাদে একদা প্রোটেস্টান্ট উপ-বিভাগের সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীর্ণ কালে ঊনবিংশ শতাব্দী সময়কালে যে আমেরিকায় ইয়োরোপের শিল্পবিপ্লবের উত্তরসূরী হিসেবে দ্রুত উৎপাদন ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পাল্টাচ্ছিল এবং নানা ধরনের উদার চিন্তার উদ্ভব ঘটেছিল, তখন ঐ আমেরিকাতেই ‘আমেরিকান প্রোটেস্টন্টিজম’-এর মধ্যে রক্ষণশীল ধর্মীয় আন্দোলনের ভেতর দিয়ে ‘ফান্ডামেন্টালিজম’-এর ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মূল বৈশিষ্ট্যগুলি ছিল—(১) খৃস্টান ধৰ্মপুস্তকগুলির অপরিবর্তনীয়। আক্ষরিক ব্যাখ্যাকে ও সেগুলির চরম অবস্থানকে খৃস্টধর্মের মৌল (fundamental) ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা, (এখন হিন্দু বা মুসলিম মৌলবাদীরা বেদ-উপনিষদমনুসংহিতা-কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্ৰ-কোরাণ-হাদিস সম্পর্কে যে মনোভাব পোষণ করেন), (২) যিশু খৃষ্ট শিগ্নিরই সশরীরে দ্বিতীয়বার আবির্ভূত হতে যাচ্ছেন-এ সম্পর্কিত বিশ্বাস, (রামরাজ্য বা ইসলামী রাষ্ট্র?), (৩) কুমারী মায়ের গর্ভে তার জন্ম সম্পর্কিত বিশ্বাস (The Virgin Birth), (8) পুনরভ্যুত্থান (resurrection) সম্পর্কিত বিশ্বাস ও (৫) প্রায়শ্চিত্ত (Atonement)।
পরবর্তীকালে, বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে, ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক মানসের বিপরীতে আমেরিকায় ফান্ডামেন্টালিজম পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এই শতাব্দীর শেষের দিকে আমেরিকায় তার প্রতিনিধি হিসেবে অসংখ্য ধর্মীয় সংগঠন (Church bodies), শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নানা সংগঠন ও সংস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এখনো এগুলি যথেষ্ট সক্রিয়। (একইভাবে ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান সহ নানা দেশে হিন্দু বা মুসলিম মৌলবাদীরাও নানা ধর্মীয় সংগঠন, শিক্ষা প্ৰতিষ্ঠান এবং গণসংগঠন বা রাজনৈতিক সংগঠন, দল, প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে।)