এই হিন্দু-মৌলবাদী ফ্যাসিবাদী অপশক্তিকে প্রতিহত করার ক্ষেত্রে মানবপ্রেমিক-দেশপ্রেমিক ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ হতেই হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় তাঁদের এই ঐক্য এখনো আশানুরূপ পর্যায়ে পৌঁছয় নি। মৌলবাদের উত্থান প্রতিরোধে বামপন্থী সহ প্রতিষ্ঠিত তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলির আন্তরিকতার অভাবও অনুভব করা যায়-যার প্রতিফলন ঘটছে বিভিন্ন রাজ্যে, এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও, পঞ্চায়েত-পুরসভাসহ নানা ক্ষেত্রের নির্বাচনে কিছু কিছু আসনে হিন্দুত্ববাদীদের বিজয়ী হওয়ার মধ্যে। এরই মধ্যে আবার কোন কোন ‘লড়াকু’। নেতা বা নেত্রী তার প্রধান শত্রু হিসেবে ‘বামপন্থীদের’ চিহ্নিত করছেন এবং হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলির সম্পর্কে একেবারেই নীরব। ব্যাপারটি উভয়ের গোপন আঁতাত ও সহমর্মিতার ইঙ্গিত দিতে যথেষ্ট এবং অদূর ভবিষ্যতে তা তাঁদের ক্ষমতায়ও বসাতে পারে–যদি না শুভবুদ্ধির উদয় হয় ও সুদৃঢ় প্রতিরোধ আসে।
তাই দেরি হয়েই যাচ্ছে।
অন্যদিকে পৃথিবীর নানা কোণে খৃষ্টীয় মৌলবাদীরাও বসে নেই। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে বড় বেশি বিলম্বিত হচ্ছে ইসলামী মৌলব্লাদীদের প্রতিহত করার কাজটিও। ইরানের মত কিছু ক্ষেত্রে সাময়িকভাবে হলেও অবস্থার কিছু পরিবর্তন তবু একটু আশা জাগায়। ইরানে সম্প্রতি (অগাস্ট, ১৯৯৭) নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে মহম্মদ খাটামি শপথ নিয়েছেন। ইনি ধর্মপ্ৰাণ হলেও আগের কট্টরপন্থীদের তুলনায় উদার। শপথ নেওয়ার অব্যবহিত পরে একজন নারীকে ভাইসপ্রেসিডেনটের পদ দিয়েছেন—১৯৭৯-এর ‘ইসলামী বিপ্লবের’ পর এই প্রথম। ইরানের কঠোর ইসলামী বিধিকে সরলীকরণ করা ও দুর্বল অর্থনীতিকে চাঙ্গা কবার জন্যও খাটামির প্রতিশ্রুতি আশাব্যঞ্জক। তবু কট্টরপন্থী ইসলামী মৌলবাদীরা তাঁর বিরুদ্ধে আক্রমণ চালু রেখেছে এবং শেষ অব্দি তিনি কতটা সফল হবেন তা এখনি বলা মুস্কিল।
কিন্তু এরই পাশাপাশি আফগানিস্থানে তালিবানদের উত্থান উদ্বেগজনক৷ ১৯৯৬-এর ২৭শে সেপ্টেম্বর তালিবানরা আফগানিস্থানে প্রেসিডেন্ট রব্বানিকে ক্ষমতাচুত করে কাবুল দখল করে। ক্রমশ বহির্বিশ্বের মানুষ জানতে পারে মৌলবাদীরা ক্ষমতায় এলে কিভাবে মানুষের অগ্রগতির ইতিহাসকে পেছনে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। মধ্যযুগীয় শরীয়তি ইসলামী আইন, মেয়েদের উপর নানা ধরনের ফতোয় ইত্যাদির মধ্য দিয়ে তালিবানরা তাদের ফ্যাসিবাদী চরিত্রের প্রকাশ ঘটায়।
আরবীতে ‘তালিব’ কথার অর্থ ছাত্র; বহুবচনে তালিবা (Taliban)। শুরুতে ছাত্রদের হাতেই গঠিত হয়েছিল এই বিপ্লবী ইসলামী বাহিনী। তালিবান সরকারের একটি ইতিবাচক দিক হল, কঠোর আইন প্রয়োগে দুনীতিগ্রস্ত আমলা ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের শায়েস্তা করা। কিন্তু ব্যাপারটি. এই নয় যে, এই ধরনের কঠোর শরীয়তি আইন না থাকলে এদের শাস্তি দেওয়া যেত না। অন্নসলে পূর্বতন সরকারেরও দুনীতি দমনের আইন ছিল। কিন্তু তার উপযুক্ত প্রয়োগ ঘটত না এবং ছিল ‘সর্ষের মধ্যেই ভূত। সাম্প্রতিক ভারতে যেমন লালু-জয়ললিতা-রাও-ভগত প্রমুখ শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা ও তাদের পরবর্তী স্তরের বহু নেতা ও আমলারা জনসাধারণের অর্থ আত্মসাৎ, স্বজনপোষণ, খুন, প্রতারণা, সীমাহীন বিলাসব্যসন ইত্যাদি নানা অপরাধে অভিযুক্ত হলেও, তাদের বিচার কবে শেষ হবে এবং অপরাধী হলে, কবে তারা শাস্তি পাবে—এ ব্যাপারটিই এখনো বিশ বঁও জলে। আফগানিস্তানেও বিগত কয়েক বছরে দুনীতির ছবিটা ছিল একইরকম। তালিবানরা এ ছবিকে নিঃসন্দেহে কিছুটা পাল্টেছে। ব্যাপারটি কঠোর শরীয়তি আইনের প্রয়োজনীয়তার চেয়ে আইনের যথার্থ ও দ্রুত প্রয়োগের গুরুত্বকে প্রতিষ্ঠা করে এবং বিচার ব্যবস্থার হাস্যকর দীর্ঘসূত্রিতা ও সীমাবদ্ধতারই পরিচয় বহন করে।
সাম্প্রতিক ভারতেও এতদিনকার ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের এই দুনীতিকে ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা তথা হিন্দু মৌলবাদীরা নিজেদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কাজে লাগাচ্ছে, প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে দুনীতিমুক্ত প্রশাসনের। ভারতীয় নাগরিকদের একাংশের মধ্যে তাদের প্রভাব বৃদ্ধির পেছনে এটিও অন্যতম ভূমিকা পালন করছে। একই ব্যাপার ঘটেছে আফগানিস্তানে তালিবানদের ক্ষেত্ৰেও। জনসাধারণের বড় একটি অংশ তালিবানদের সমর্থন করছে তাদের কঠোর ইসলামী ফৌজদারি আইন প্রয়োগ করে দুনীতিপরায়ণ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়ার জন্য—যা বিগত প্ৰায় এক দশকে ওখানে প্রায় হয়ই নি। মৌলবাদীরা কিভাবে নানা কৌশলে জনভিত্তি অর্জনের প্রচেষ্টা চালায় তা এ থেকে বোঝা যায়। ফ্যাসিস্টরা ক্ষমতায় আসায় আগে এভাবেই সাধারণ মানুষকে মনোমুগ্ধকর নানা কথাবার্তা দিয়ে মোহগ্ৰস্ত করে,-জার্মানিতে হিটলার যেমন বলেছিল বিশুদ্ধ আৰ্য রক্তের জার্মানজাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করার কথা, ভারতে তেমনি বলা হচ্ছে হিন্দুত্ব ও পবিত্র হিন্দু ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার কথা। সঙ্গে উন্নত ও স্বনির্ভর অর্থনীতি থেকে দুনীতিমুক্ত প্রশাসনের আপাত জনস্বার্থবাহী গাজর খাওয়ানোও হয়। এবং এইভাবেই আড়াল করা হয় তাদের ধর্মীয় মৌলবাদী তথা প্ৰগতিবিরোধী, বিজ্ঞান-বিরোধী সাম্প্রদায়িকতাবাদী চরিত্র, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে।