মৌলবাদের স্থায়ী প্রতিরোধে শ্রেণীসংগ্রাম ও দীর্ঘস্থায়ী প্রচার অবশ্যই থাকা প্রয়োজন। তা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের অংশও বটে। কিন্তু মৌলবাদ যখন দরজায় কড়া নাড়ছে, তখন কবে জনগণ সংগঠিত হয়ে একটি সঠিক, বামপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলন বা শ্রেণীসংগ্রাম শুরু করবেন, ঐ অপেক্ষায় দরজা বন্ধ করে বসে না থেকে প্রত্যক্ষ লড়াইয়ের উদ্যোগও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত ধর্ম যখন বিশেষ শ্রেণীর একটি শক্তিশালী হাতিয়ারে পরিণত হয়ে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার জন্ম দিচ্ছে, তখন ধর্মের এই ব্যবহারের বিরুদ্ধে এবং মৌলবাদসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্ৰত্যক্ষ সংগ্রাম করার অর্থ ‘শ্রেণীসংগ্ৰাম’-ই করা,–তা আংশিক হলেও এবং তাকে এইভাবে চিহ্নিত না করা হলেও। মৌলবাদের তাংক্ষণিক চিকিৎসার জন্য এই লড়াইয়েরই অংশ ধর্মের বিরুদ্ধে উচ্চনাদের যুদ্ধ ঘোষণাও।
মৌলবাদ বিরোধী জনগণের ব্যাপক যুক্তফ্রন্ট এই যুদ্ধের নেতৃত্ব দেবেন। এই যুক্তফ্রন্টে বামপন্থী বিপ্লবী থেকে সরল ধর্মবিশ্বাসী ব্যক্তিরা যেমন, তেমনি মৌলবাদবিরোধী বুর্জেয়া ব্যক্তিত্ব থেকে বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদী মানুষরাও যুক্ত হবেন। ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধে বা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে যেমন ব্যাপক যুক্তফ্রন্টের প্রয়োজন, তেমনি ফ্রন্টের প্রয়োজন ধর্মীয় মৌলবাদ প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও। ধর্মীয় মৌলবাদ সম্পূর্ণত (অন্তত বাহ্যিকভাবে) ধর্মকেন্দ্ৰিক ধর্মের রীতিনীতি, অনুশাসন, আচার অনুষ্ঠানকে সামনে রেখেই তার জন্ম ও বেঁচে থাকা।
হতে পারে না। এর ফলে ধর্ম সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হবে কিনা তা অন্য প্রশ্ন, কারণ এটি জড়িত প্ৰাকৃতিক ও বিশেষত সামাজিক জনবিরোধী প্রতিকুল শক্তিগুলির সম্পূর্ণ উচ্ছেদের সঙ্গে। কিন্তু মৌলবাদকে আটকাতে,-’এখনকার জাতীয় ও আন্তজার্তিক পরিস্থিতিতে, ‘শ্রেণী:আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট অনুশীলনের’ লক্ষ্য সামনে রেখেও তার জন্য শুধু অপেক্ষা করে গেলে, বড় বেশি দেরি হয়ে যাবে না তো?
***
হ্যাঁ, দেরি হয়েই যাচ্ছে।
সাম্প্রতিককালে ভারতীয় ভূখণ্ডে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি ও মৌলবাদীদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব যেমন এর অন্যতম দিক, তেমনি আফগানিস্থানে তালিবানদের উদ্বেগজনক উত্থান তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য নির্দেশক।
ভারতের হিন্দু মৌলবাদীদের জোট নানা কৌশলে জনসাধারণের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা ও ভিত্তি বিস্তুত করে চলেছে। এরা তাদের মূল লক্ষ্য অর্থাৎ রাষ্ট্ৰক্ষমতা দখলের ও হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাকে অপরিবর্তিত রেখে, এই লক্ষ্য অর্জনের কৌশলগুলি সুবিধাজনকভাবে পাল্টায়। কখনো তারা অযোধ্যায় রামমন্দির গড়া ও বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার আহ্বান জানায়, কখনো বা প্রতিশ্রুতি দেয় দুনীতিমুক্ত প্রশাসন ও উন্নত স্বনির্ভর অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার। দোহাই দেয় নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, তথাকথিত জাতীয়তা ইত্যাদি নানাবিধ মনোমুগ্ধকর ও বিভ্রাস্তিকর বিষয়ের।
হিন্দু মৌলবাদীদের অন্যতম মুখপত্ৰ স্বামী মুক্তানন্দ স্পষ্টই বলেছিলেন, ‘হিন্দুর নামে যে রাজনীতি করে তাকেই আমরা শ্রেষ্ঠ বলে মানি। কারণ হিন্দুরা সাম্প্রদায়িক নয়।’ এবং ১৯৯২-এর ৬ই ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা প্রসঙ্গে তার বক্তব্য, ‘ওগুলির ধ্বংস কেবলমাত্র হিন্দুমন্দির ধ্বংসের প্রতিশোধেই ঘটে। হিন্দুরা সঙ্ঘবদ্ধভাবে কখনোই মসজিদ ধ্বংস করে না। কিছু বালক যেমন ফুর্তি করার জন্য মসজিদ ভাঙ্গে’ (মেইনষ্ট্ৰীম, ৩০.১০.৯৩)।
হিন্দু মৌলবাদীদের প্রধান রাজনৈতিক সংগঠন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) তার ১৯৯৬-এর নির্বাচনী ইস্তেহারে দ্বিধাহীনভাবে ঘোষণা করে ‘হিন্দুত্বই সেই একমাত্র সংযোগসূত্র যা আমাদের জাতির ঐক্য এবং সংহতি রক্ষা করতে পারে।’–হ্যাঁ, এদের কাছে ভারতীয় হিসেবে পরিচয় নয়, হিন্দু হিসেবে পরিচয়ই একমাত্র গ্রহণীয়। তাই ১৯৮০ সালে প্রথম বিশ্বহিন্দু পরিষদের প্রকাশ্য ঘোষণা—All nonHindus are aliens (সমস্ত অহিন্দুই বিদেশী)
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও আমেরিকা বা প্রথম বিশ্বের দেশগুলির প্রতি এদের দুর্বলতা, তথা সাম্রাজ্যবাদী ও কম্যুনিজম-বিরোধী শক্তিগুলির সঙ্গে এদের সহমর্মিতার আঁচও নানা ক্ষেত্রে পাওয়া যায়। বিজেপির নির্বাচনী ইস্তেহারে যেমন বলা হয়েছে ‘চীন যে পাকিস্থানকে অস্ত্র ও নানাবিধ সাহায্য করছে সে সম্পর্কে উদাসীন হলে চলবে না।’ অথচ একই ধরনের কাজ আমেরিকা ও অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী দেশ ও বহুজাতিক সংস্থারা করলেও সে সম্পর্কে তা নীরব।
শিক্ষা, নারী, অর্থনীতি, বৈদেশিক নীতি-ইত্যাদি সমস্ত ক্ষেত্রে হিন্দুত্বকেন্দ্ৰিক ভয়াবহ মৌলবাদী ভাবনাকে নানা কৌশলে ভারতীয় জনমাসনে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলছে। এরইসঙ্গে নানা ধরনের রাজনৈতিক সুবিধাবাদ, ধান্দাবাজি ও বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে হয়তো কয়েক বছরের মধ্যে ভারত একটি হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত হয়ে যাবে,-যখন ‘ভারত’ বা ‘ইন্ডিয়া’ নামটি মুছে দিয়ে রাষ্ট্রের নাম হবে হিন্দুস্থান, যে রাষ্ট্রে ধর্মপরিচয়ই হবে নাগরিকদের প্রধানতম পরিচয়, তথাকথিত হিন্দুনেতারা ও তাদের মধ্যেও মূলত উচ্চবর্ণের হিন্দুরাই থাকবে শাসন ক্ষমতায়, এই শাসকগোষ্ঠীরও নৈতিক নেতৃত্ব দেবে পরিশ্রমজীবী সাধুসন্তের দল, হিন্দু ছাড়া ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা হবে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, সম্প্রদায়গত দাঙ্গা ও অসহিষ্ণুতা হবে তীব্র, নারীরা হবে গৃহকোণে আবদ্ধ ও শুধুমাত্র সস্তানের জন্মদাত্রী, সমস্ত ধরনের মুক্ত উদার ও বৈজ্ঞানিক চিন্তা হবে কঠোরভাবে অবদমিত, সাম্রাজ্যবাদী শোষণ হবে আরো তীব্র ও সূক্ষ্ম, শিক্ষাদীক্ষা হবে মধ্যযুগীয় ইত্যাদি। হিটলারের ইহুদি নিধনের মত মুসলিম-খৃষ্টানদের গণহত্যাও ভিন্ন পদ্ধতিতে সংঘটিত হতে পারে,-যদি না তারা নিঃশর্তে হিন্দুত্বকে বরণ করে।