‘শ্রমিকদের রাজনৈতিক দলের কর্মসূচীতে নাস্তিক্যবাদের সুস্পষ্ট ঘোষণা অন্তর্ভুক্ত’ করার মত পরিস্থিতি এখনো হয়তো আসেনি, কিন্তু ধর্ম প্রসঙ্গে বিজ্ঞানমনস্কতার ও মৌলবাদ-বিরোধিতার সুস্পষ্ট ঘোষণা অন্তর্ভুক্ত করার সময় এসেছে এবং গণবিজ্ঞান আন্দোলনের পাশাপাশি শ্রেণী সচেতন ও বস্তুবাদী দর্শনে শিক্ষিত নাস্তিক্যবাদী সংস্থার প্রয়োজনও এখন অনেক বেশি বলেই প্রতীয়মান হয়। এটি ঠিক যে, এখন থেকে ৭০ বছরেরও বেশি সময় আগে চীনের হুনানে সঠিক পথে সঠিক নেতৃত্বে পরিচালিত অল্প কয়েক বছরের কৃষক আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে কৃষকরা যেমন ধর্মীয় কর্তৃত্বের জোয়াল ভেঙে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে প্রস্তুত হয়েছিলেন, বর্তমান বাংলায়, ভারতে বা অন্যান্য কিছু দেশে দীর্ঘ কয়েক দশকের ‘বামপন্থী কৃষক আন্দোলনের’ পরে অন্তত ধর্মীয় ক্ষেত্রে ঐ প্রস্তুতির অনেকটাই এখনো বাকি। কবে এই আন্দোলন ‘বামপন্থী’ হবে ও রাজনৈতিক মৌলবাদী মানসিকতামুক্ত হবে কে জানে! তবু অন্তত ধর্মীয় মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধিতার প্রশ্নে এই ধরনের সমস্ত বামপন্থী সংগঠনের মধ্যকার ঐক্য এবং ধর্মনিরপেক্ষ ও নাস্তিক্যবাদী সংস্থা বা গণবিজ্ঞান সংগঠনগুলির সঙ্গে সহযোগিতামূলক কর্মসূচী যে নেওয়া হবে —এ আশা ব্যক্তি করা যায়।
এঙ্গেলস ভয় করেছিলেন, ধর্মের বিরুদ্ধে উচ্চনাদের যুদ্ধ ঘোষণা ধর্মের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়িয়ে তুলবে এবং ধর্মকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করবে। এখনকার পরিস্থিতিতে এটিও কতটা সত্য তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। এর বড় কারণ ধর্মের বিরুদ্ধে উচ্চনাদের যুদ্ধ ঘোষণা এখন কোন রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে ততটা আসছে না, যতটা আসছে মূলত মানুষের দ্রুত বিকশিত বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের তথা প্রকৃতি সম্পর্কে সত্য উপলব্ধির থেকে। বিবর্তনবাদ ছিল এ ধরনের প্রথম বড় যুদ্ধ ঘোষণা। তারপর জৈব অণুর কৃত্রিম সৃষ্টি থেকে কোয়ান্টামতত্ত্ব বা আপেক্ষিকতার তত্ত্ব সহ ব্ৰহ্মাণ্ড সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান জ্ঞানের এই পরিবেশে ঈশ্বর ও ঈশ্বর বিশ্বাসকেন্দ্ৰিক ধর্মের অবস্থানটিই ক্ৰমশঃ হাস্যকর হয়ে উঠছে। এ অবস্থায় স্বাভাবিকভাবে ঐ অনুযায়ী ঐতিহ্যমণ্ডিত মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গীও পরিবর্তিত হচ্ছে। কেঁপে উঠছে ধর্মের ভিত্তি। এর প্রতিক্রিয়ায়ও ধর্মান্ধতা বা মৌলবাদের সৃষ্টি হয় ও হচ্ছে, কিন্তু তা আটকাতে এই উচ্চনাদের যুদ্ধ ঘোষণা তথা জ্ঞানচর্চা বন্ধ হবে না, হওয়া উচিতও নয়। অর্থনৈতিক-ও শ্রেণী-সংগ্রামের পাশাপাশি এই বৈজ্ঞানিক সত্যোপলব্ধিও ধর্ম তথা ধর্মীয় মৌলবাদের মৃত্যুঘণ্টা বাজাবে।
এখন থেকে ১০০ বছর আগে, এঙ্গেলসদের সময় ধর্মের বিরুদ্ধে তীব্র লড়াইয়ের ডাক ধৰ্মকে শহিদ করে তার প্রতি মানুষের সহানুভূতি বাড়াত। কিন্তু এখন হুবহু এ পরিস্থিতি নেই, যদিও এ ধরনের সহানুভূতি পাওয়ার পরিবেশ স্থানবিশেষে একেবারে নেই তা-ও নয়। তবে এখন পৃথিবীর ১১৫ কোটিরও বেশি মানুষ ধর্ম ও ঈশ্বরের মোহ থেকে মুক্ত, কয়েক দশক আগেও যা ভাবাই যেত না। এঁদের মধ্যে উদার বুর্জেয়া, অজ্ঞাবাদী (agnostic) ও বিজ্ঞানীসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ যেমন আছেন, তেমনি আছেন মার্কস-এঙ্গেলসদেরই শিক্ষায় উদ্ধৃদ্ধ মানুষও। এছাড়া আরো বহুসংখ্যক মানুষই রয়েছেন যাঁরা অতি আলগা ভাবেই (কখনো বা নিছকই সুবিধাজনক হিসেবে) ধর্মও ঈশ্বরকে আঁকড়ে আছেন এবং এঁদের বৃহদংশ দোদুল্যমান অবস্থায় থাকেন। প্রকৃতপক্ষে নাস্তিক ও ধর্মপরিচয়মুক্ত হিসেবে নিজেদের সরকারীভাবে ঘোষণা না করা বাকী প্রায় শতকরা ৭৯-৮০ ভাগ পৃথিবীবাসীরও ৯০ ভাগই প্রকৃত বা আদৌ ধর্মাচরণ করেন না বলেই জানা গেছে। এঁদের কাছে ধর্মপরিচয় ও ঈশ্বর একটা কায়াহীন ঐতিহ্যগত অভ্যাস মাত্র। এছাড়া কয়েক শতাব্দী পূর্বে তো বটেই, বিগত শতাব্দীতেই ধর্ম যেমন রাষ্ট্ৰীয় ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা পালন করত, এখন ঐ পরিস্থিতিও নেই।
সব মিলিয়ে, ১৮৭৪ সালে এঙ্গেলস ধর্মের বিরুদ্ধে উচ্চনাদের যুদ্ধ ঘোষণাকে ধর্ম সম্পর্কে আগ্রহ নতুন করে আগ্রহ জাগিয়ে তোলার এবং এটিকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষণ করার সর্বোত্তম উপায় হিসেবে যে অভিহিত করেছিলেন, এই ১২০ বছর পরে ঐ পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়েছে কিনা, তা ভেবে দেখার সময় বামপন্থীদেরও এসেছে, বিশেষত মৌলবাদীদের সাম্প্রতিক দাপটের পরিস্থিতিতে এবং আন্তর্জাতিক ভাবে বামপন্থী আন্দোলনের বিভ্রান্তির সময়ে। শ্রেণী সংগ্রাম ও শোষিত মানুষের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী প্রচারের গুরুত্বকে সামান্যতম খাটো না করেও এটি বোধহয় বলা যায় যে, ধর্মের বিরুদ্ধে উচ্চনাদের যুদ্ধ ঘোষণার পরিস্থিতি ও সময় এগিয়ে এসেছে। বাস্তবিক দেখা যাচ্ছে, ধর্মের বিরুদ্ধে এ ধরনের লড়াইয়ের ডাক দেওয়ার ফলে মৌলবাদীরা যেমন ক্ষিপ্ত হচ্ছে, তেমনি পৃথিবীর বহু মানুষ এই লড়াইকে সমর্থন করতেও এগিয়ে আসছেন। এরা নানা ধরনের উদ্দেশ্য থেকে তা করতে পারেন, কিন্তু মৌলবাদ প্রতিরোধে এদের এই ভূমিকা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরনের লড়াইয়ের প্রতিক্রিয়ায় মৌলবাদীরা যে হিংস্ৰ মনোভাব প্রকাশ করে, তাতে তাদের স্বরূপ আরো নগ্নভাবে মানুষের সামনে পরিস্ফুটও হয়। (সম্প্রতি তসলিমা নাসরিন বা সলমন রুশদির মত ব্যক্তিদের সমর্থনে নানা স্তরের মানুষ যেভাবে সমবেত হয়েছেন, তাতে এটি স্পষ্ট যে, ধর্মের বিরুদ্ধে তীব্র ও প্রত্যক্ষ লড়াই ধর্মকে ‘মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার সর্বোত্তম পন্থা’ আর নয়। পুঁজিবাদী সংস্কৃতির ধারক ও বাহকেরা নিজ স্বার্থে ও আপন অস্তিত্বের স্বার্থে এঁদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে এগিয়ে আসছে, এটি হয়তো আংশিক সত্য এবং এ ব্যাপারে বিতর্কের অবকাশও আছে। কিন্তু সাম্প্রতিক দুনিয়ায় মৌলবাদ প্রতিরোধে যে মৌলবাদ-বিরোধী ব্যাপক যুক্তফ্রন্ট গড়ে তোলা দরকার তাতে এ ধরনের ব্যক্তি ও তাদের সমর্থকদের ভূমিকা অবশ্যই মূল্যবান ও অবিচ্ছেদ্য)।